চ লচ্চিত্রের পর্দায় হয় বটে, কিন্তু বাস্তব আদালতকক্ষে হাততালির ঝড় বহিয়া যাওয়া নিতান্ত বিরল। নির্ভয়া মামলায় চার অভিযুক্তের বিরুদ্ধেই ফাঁসির আদেশ বহাল থাকিল, সুপ্রিম কোর্টে বিচারকরা তাঁহাদের এই রায় ঘোষণা করিবার পর সেই বিরল ঘটনাটিই ঘটিল। এখনও আপিল করিবার, ক্ষমাভিক্ষার সুযোগ আছে বটে, কিন্তু নিম্ন আদালতের রায় হাইকোর্ট হইয়া সুপ্রিম কোর্টেও অপরিবর্তিত থাকায়, অনুমান করা চলে, আদালতকক্ষে উপস্থিত অনেকেরই মনে একটি সমাপ্তির অনুভূতি জাগিয়াছে। যাহারা নির্ভয়াকে নৃশংস ভাবে মারিয়াছিল, বিচারব্যবস্থা তাহাদের কঠোরতম সাজা দিয়াছে— সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসী এই পরিসমাপ্তিতে ন্যায়বিধান দেখিবেন। অবশ্য, কম সংখ্যায় হইলেও কিছু মানুষ প্রশ্ন তুলিয়াছেন, ফাঁসি দিলেই কি রাষ্ট্রের দায় ফুরাইয়া যায়? তাহাতে প্রতিশোধ হয় বটে, এমন ঘৃণ্য অপরাধের কারণগুলি বিনষ্ট হয় না। আপত্তিটি উড়াইয়া দেওয়ার নহে। প্রশ্ন দুইটি: এক, এই চার জন যে অপরাধ করিয়াছে, তাহার জন্য ফাঁসি ভিন্ন আর কোনও শাস্তি দেওয়ার কি উপায় ছিল না; দুই, অপরাধীদের ফাঁসি দিলেই কি সমাপ্তি, না কি আরও কিছু করণীয় আছে?
আদালত জানাইয়াছে, অপরাধীদের তরুণ বয়স, তাহাদের অর্থনৈতিক অবস্থা বা জেলবন্দি অবস্থায় ভাল আচরণ— কোনও যুক্তিই তাহাদের মৃত্যুদণ্ড রদ করিবার জন্য যথেষ্ট নহে। সত্যই যদি কোনও অপরাধে ফাঁসি দিতে হয়, তবে তাহা এই অপরাধটিই। কেন, তাহা ব্যাখ্যা করিয়া আদালত জানাইয়াছে, নির্ভয়ার প্রতি নৃশংসতায় অপরাধীরা সভ্য সমাজের যাবতীয় সীমানা তো বটেই, মানবতার ন্যূনতম শর্তগুলিও লঙ্ঘন করিয়াছিল। শুধু ধর্ষণ নহে, শুধু হত্যা নহে, তাহাদের আচরণের মধ্যে যাহা ছিল, তাহা গোটা সমাজের শিরদাঁড়া দিয়া শীতল স্রোত বহাইয়া দিয়াছে। সমাজের মধ্যে এক গভীর অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হইয়াছে। ফলে, অপরাধটি সাধারণ নহে। রায়দানকারী বেঞ্চের অন্যতম বিচারক ভানুমতী একটি পৃথক রায়ে ভিন্নতর একটি প্রশ্ন উত্থাপন করিয়াছেন। এই অপরাধটি লিঙ্গ-নিরপেক্ষ নহে, তাহা নারীর প্রতি অপরাধ। পুরুষ ঘাতকদের তুলনায় নির্ভয়া শারীরিক ভাবে দুর্বলতর ছিলেন বলিয়া নৃশংসতার তীব্রতাও বাড়িয়াছিল— নারী বা শিশুর প্রতি অপরাধের ক্ষেত্রে যাহা ঘটিয়া থাকে। বিচারক ভানুমতী প্রশ্ন করিয়াছেন, লিঙ্গ-ন্যায়ের যে দর্শন আদালত স্বীকার করে, তাহা কি শুধু কাগজকলমে থাকিবার জন্য? নির্ভয়ার হত্যাকারীদের প্রতি কঠোরতম শাস্তিবিধান লিঙ্গভিত্তিক অপরাধের প্রতি আদালতের আপসহীন অবস্থানেরও প্রকাশ। মৃত্যুদণ্ডের প্রতি মূলগত আপত্তি— কাহারও প্রাণ কাড়িয়া লইবার অধিকার রাষ্ট্রের থাকিতে পারে না— সরাইয়া রাখিলে দেশের শীর্ষ আদালতের এই অবস্থানটির যাথার্থ্য অস্বীকার করা চলে না।
তবে, চার অপরাধীকে ফাঁসিকাঠে ঝুলাইলেই যে লিঙ্গ-অপরাধের সংখ্যা কমিবে না, বিচারক ভানুমতী একই রায়ে সেই কথাটিও বলিয়াছেন। কঠোর শাস্তির দৃষ্টান্ত জনমানসে খানিক ভীতি তৈরি করে, সন্দেহ নাই, কিন্তু পুরুষতন্ত্রের আবহে গড়িয়া উঠা প্রবৃত্তিকে দমন করিতে সেই ভীতি যথেষ্ট নহে। বিচারক বলিয়াছেন, শৈশব হইতেই নারীকে সম্মান করিবার কথাটি শিখাইতে হইবে। দায়িত্ব অভিভাবকদের, স্কুলের, সমাজেরও। শিশুদের সহিত নিয়মিত আলোচনা করিতে হইবে, তাহাদের আচরণের দিকেও নজর রাখিতে হইবে। পাশাপাশি, পথেঘাটে পুলিশের নজরদারি বৃদ্ধি, আরও বেশি আলো, নারী-নিরাপত্তা হেল্পলাইন ইত্যাদিও অতি জরুরি। অর্থাৎ, লিঙ্গ-অপরাধের রাশ টানিতে হইলে কোনও একটি অস্ত্রের উপর নির্ভর করিলে চলিবে না— মানসিকতার পরিবর্তন হইতে সুরক্ষা বৃদ্ধি এবং অতি কঠোর শাস্তির ভীতি, সবই সমান জরুরি।