ফাইল চিত্র।
গত সপ্তাহের মঙ্গলবার দিল্লির রামলীলা ময়দান ও ঝান্ডেওয়ালার মধ্যবর্তী অঞ্চলটি রীতিমতো জনসমুদ্রস্রোতে পরিণত হইয়াছিল। অঞ্চলটি বড় ছোট নহে। অলক্ষ্যও তাহাকে বলা চলে না। তবু ভারতের সংবাদ-দুনিয়ায় তেমন তরঙ্গ উঠিতে দেখা গেল না। অবশ্যই কোন সংবাদে কেমন তরঙ্গ দেখা যাইবে, সংবাদের আকারপ্রকারের উপর তাহা নির্ভর করে না, রাজনীতির গতিপ্রকৃতির সহিত পাল্লা দিয়াই তাহা নির্ধারিত হয়। এই বিশালাকার দলিত মিছিল ও সমাবেশ যে তত গুরুত্ব পাইল না, তাহার কারণও তাই রাজনীতি-গত। যে রাজনীতির প্রবাহে উত্তরপ্রদেশে আজমগড়-সংলগ্ন তিনটি গ্রামে রাতারাতি বাবাসাহেব ভীমরাও অম্বেডকরের মূর্তি হইতে মাথাগুলি কাটা পড়ে, ঠিক সেই রাজনীতির জন্যই বৃহৎ দলিত সমাবেশকেও তাহার প্রাপ্য গুরুত্ব দেওয়া হয় না। রাজনীতি ও পাল্টা রাজনীতির এই আলোকেই বর্তমান ভারতের দলিত বিক্ষোভের কারণ ও সম্ভাবনাকে বুঝিতে হইবে। দিল্লি বিকাশ প্রাধিকরণ বা দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটির তত্ত্বাবধানে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে রবিদাস মন্দিরকে ধুলায় মিশাইয়া দিবার প্রতিবাদে ঘটিয়াছিল এই সমাবেশ। পঞ্জাব, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা হইতে বহুসংখ্যক দলিত মানুষ ইহাতে অংশগ্রহণের জন্য রাজধানী আসিয়া পৌঁছাইলেন। তাঁহাদের সম্মিলিত ‘জয় ভীম’ স্লোগানে মুখরিত হইল দিল্লি। দলিতদের প্রতি উপেক্ষা, অবহেলা ও বিদ্বেষের পরিমাণ যে বর্তমান রাজনীতিতে ও সমাজে কত ব্যাপক ও গভীরপ্রসারী, অম্বেডকর মূর্তির উপর আক্রমণই তাহা বলিয়া দেয়। তাই পঞ্জাবে ১৩ অগস্টের আন্দোলন সারিয়া পরের সপ্তাহে দলিতরা দিল্লিতে আসিয়া পৌঁছাইলে হিন্দুত্ব-মগ্ন সমাজ ও তাহার বিজেপি শাসকের স্বস্তি পাইবার কথা নহে।
প্রশ্ন হইল, স্বস্তি না পাইলেও বিজেপি শাসকবর্গের ভয় পাইবার কারণ আছে কি? দলিত বিক্ষোভ তো নরেন্দ্র মোদীর প্রথম দফার প্রধানমন্ত্রিত্বকালেও দেখা গিয়াছিল। সেই অসন্তোষকে তো ইভিএম মেশিনে ব্যক্ত হইতে দেখা যায় নাই। তবে কি উচ্চবর্ণ রাজনীতির সহিত নিম্নবর্ণ রাজনীতির সংঘর্ষ যতটা গভীর মনে হয়, আসলে ততটা নহে? উত্তর এখনও স্পষ্ট নয়। এমনকি দলিত রাজনীতির পণ্ডিতরাও উত্তর হাতড়াইয়া বেড়াইতেছেন। যে দুই-একটি বক্তব্য আপাতদৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ, তন্মধ্যে একটি হইল দলিত রাজনীতির অভ্যন্তরীণ ভেদাভেদ। নিম্নবর্ণ বলিতে ভারতের জনসংখ্যার যে বিস্তীর্ণ অংশকে বুঝায়, তাঁহারা খেপিয়া উঠিলে বিজেপি কংগ্রেস কোনও দলেরই যেমন টিকিবার কথা নহে, তেমনই এত বিস্তীর্ণ অংশের দলিত সমাজ যে একশৈলিক বা একপথগামী নহে, তাহাও বাস্তব। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নিম্নবর্ণের মধ্যে একটি বিশেষ জাত অন্যান্য জাতের উপর ছড়ি ঘুরাইতেছে। যেমন, উত্তরপ্রদেশে জাতভরা। সেই জাত আঞ্চলিক ভাবে ভোটের ফল প্রভাবিত করিতে পারিলেও বৃহত্তর ভিত্তিতে ভোট হইলে বিপক্ষে মতদানের লোকের সংখ্যাও কম নহে। উত্তরপ্রদেশে বিগত উপনির্বাচনগুলির ফলের সহিত লোকসভা ভোটের ফলের এত বড় তফাতের পিছনে ইহা আংশিক হেতু। তদুপরি স্মরণীয়, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ অনলস ভাবে ছোট ও নিচু জাতগুলির মধ্যে সংহতি ও ঐক্যের কাজে লাগিয়া আছে, যাহার ফলে চরমভাবাপন্ন দলিত গোষ্ঠীনেতাদের প্রভাব বিস্তারে বিঘ্ন ঘটিতেছে। অর্থাৎ নানা রাজ্যের দলিত বিক্ষোভের আপাত-একতার মধ্যে আছে দলিত রাজনীতির জটিল ও পরস্পরবিরোধী ধারাসমূহ। তাই গত বৎসরের ভীম আর্মির বিক্ষোভ-সাফল্যের পাশাপাশিই থাকে এই বৎসরে তাহার নির্বাচনী অসাফল্য। উচ্চবর্ণের সহিত স্বার্থসংঘর্ষ ও নিম্নবর্ণের মধ্যে অসংখ্য অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব— এই দুই মিলিয়া ভারতের দলিত রাজনীতি যেন ঘূর্ণিপথে অগ্রসর হইতেছে। সেই ঘূর্ণির চূড়ান্ত অভিমুখ এখনও স্পষ্ট নয়।