নির্মলা সীতারামন জানাইয়াছেন, ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকের আয় তাঁহারা ২০১৭ সালের আয়ের দ্বিগুণ করিয়াই ছাড়িবেন। পাঁচ বৎসরে কৃষকের আয় দ্বিগুণ পৃথিবীর ইতিহাসে সম্ভবত কখনও হয় নাই। হইতে, কৃষিক্ষেত্রে বার্ষিক বৃদ্ধির হার প্রায় ১৫ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন। দুনিয়ায় কোথাও কখনও হয় নাই, কিন্তু ভারতে হইবে, কারণ প্রতিশ্রুতিটি নরেন্দ্র মোদী দিয়াছেন। তবে, নির্মলারা প্রধানমন্ত্রীকে যতখানি মান্যগণ্য করেন— দুর্জনের মতে, যতখানি ডরান— বৃদ্ধির হার এখনও ততখানি অনুগত হইতে পারে নাই। ফলে, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির পরের বৎসরে কৃষিতে যদিও বা সাড়ে তিন শতাংশ বৃদ্ধি হইয়াছিল, তাহার পরের দুই বৎসরে সেই বৃদ্ধির হার তিন শতাংশের বেড়া টপকাইতে পারে নাই। অর্থাৎ, ২০১৭ সালের মার্চে যে কৃষিজীবীর ১০০ টাকা আয় ছিল, ২০২০ সালের মার্চে তাহা বড় জোর ১০৯ টাকা ৫০ পয়সায় ঠেকিবে। অবশ্য ইহা প্রকৃত আয়ের হিসাব— নরেন্দ্র মোদীদের নিকট তাহার কোনও অর্থ আছে বলিয়া সন্দেহ হয় না। তাঁহারা টাকার অঙ্কে হিসাব বোঝেন— বাজেট-বক্তৃতায় নির্মলা বৃদ্ধির হার বলিতে সেই হিসাবই দিয়াছেন। কৃষিতে প্রকৃত বৃদ্ধির হারের সহিত মূল্যবৃদ্ধির হারটিকেও ধরিয়া লইলে নমিনাল আয় মিলিবে। সেই হিসাবেও ২০২০ সালে কৃষকের আয় দাঁড়াইবে বড় জোর ১২৫ টাকা। ২০২২ সালের মধ্যে সেই আয়কে ২০০ টাকায় লইয়া যাইতে হইলে আগামী দুই অর্থবর্ষে কৃষিতে বৃদ্ধির হার হইতে হয় বৎসরে ২৬.৪৯ শতাংশ।
এই বাজেটে নির্মলার ঘোষণাকে যদি সত্য মানিতে হয়, তবে তিনি কৃষিক্ষেত্রে এই হারে আয় বাড়াইবার কথাই বলিয়াছেন। কথাটি সম্ভবত তাঁহার নিকটও অবিশ্বাস্য ঠেকিবে। তাহা হইলে, অর্থমন্ত্রী সম্বন্ধে যে কথাটি বলিতে বাধোবাধো ঠেকে, তাহা বলা ভিন্ন আর পথ থাকে না— অর্থমন্ত্রী সংসদে দাঁড়াইয়া, সজ্ঞানে, মিথ্যা বলিলেন। গত ছয় বৎসরে এই সরকার বহু বার বুঝাইয়া দিয়াছে, সাধারণ মানুষ সম্বন্ধে তাহাদের বিশেষ শ্রদ্ধা নাই। কিন্তু, কৃষিজীবীদের সহিত এই নিষ্ঠুর রসিকতাটি যত দিন যাইতেছে, ততই মর্মান্তিক হইতেছে। এই বার তাঁহারা থামিলে পারেন। থামিবার লক্ষণ অবশ্য নাই। নির্মলা জানাইয়াছেন, কৃষিক্ষেত্রে আয়বৃদ্ধির পথ সংস্কার। কথাটি ভুল নহে, কিন্তু ভয়ানক রকম অসম্পূর্ণ। সংস্কার বলিতে অর্থমন্ত্রী যদি শুধু ই-বাজারের কথা ভাবেন, তবে মুশকিল। সংস্কার স্বভাবতই বহুমুখী। তাহার জন্য গ্রামাঞ্চলে রাস্তা নির্মাণ করা যেমন প্রয়োজন, প্রতিটি ব্লকে যথাযথ কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থা করা যেমন প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন কৃষিক্ষেত্রে— বিশেষত মাঝারি, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য— পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ। প্রয়োজন কার্যকর ফসল বিমা।
শুধু বাজার খুলিয়া দিলেই হয় না, সেই বাজারে যাহাতে কৃষক নিজের স্বার্থরক্ষা করিয়া অংশগ্রহণ করিতে পারে, তাহা নিশ্চিত করা জরুরি। কৃষকদের জন্য বিশেষ তথ্য-নেটওয়ার্ক তৈরিতে জোর দেওয়া বিধেয়। তাহাতে আবহাওয়ার আগাম পূর্বাভাস যেমন মিলিবে, তেমনই কৃষক আগাম জানিতে পারিবেন, কোন ফসলের চাহিদা কেমন হইবে, অথবা ফসল উৎপাদনের পর বাজারে মূল্যস্তর কেমন চলিতেছে। কৃষককে তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির পূর্ণ সুবিধা দেওয়া সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ দিক তো বটেই। অন্য একটি দিক হইল, কৃষির খুচরা বিপণনে বিদেশি লগ্নিতে ছাড়পত্র দেওয়া। বড় লগ্নি আসিবার অর্থ, কৃষি পরিকাঠামোর উন্নতিসাধন; কৃষি বিপণনে মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির গুরুত্ব হ্রাস। তাহাতে কৃষকেরও লাভ, উপভোক্তারও লাভ। নির্মলা সীতারামনের বাজেটে এই প্রসঙ্গগুলির উল্লেখমাত্র নাই। সরকার যদি সত্যই এই কাজগুলি করিত, তবুও কৃষিক্ষেত্রে পাঁচ বৎসরে আয় দ্বিগুণ হইত না। তবে, সরকারের মিথ্যার বোঝা কমিত। তাহা কম লাভ নহে।