সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে তাঁহার পরবর্তী চার প্রবীণতম বিচারক এতটাই ক্ষুব্ধ যে সাংবাদিক সম্মেলন ডাকিয়া সেই ক্ষোভ জানাইতেছেন, ভারতীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করিতেছেন— এই অভূতপূর্ব ঘটনা চিরকাল অভূতপূর্ব থাকাই শ্রেয় ছিল। সমস্যা যত গভীরই হউক, বিচারপতিরা ‘জনতার আদালত’-এ অবতীর্ণ হইতে পারেন কি না, অনেকেই সেই প্রশ্ন তুলিয়াছেন। বিচারবিভাগের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রাখিয়াও এই প্রশ্ন উড়াইয়া দেওয়া চলে না। কিন্তু এই সত্যও অনস্বীকার্য যে, তাঁহাদের উদ্বেগ ও ক্ষোভ অহেতুক নহে। শুক্রবারের ঘটনাটি আকাশ হইতে পড়ে নাই। প্রধান বিচারপতির কর্মপদ্ধতি লইয়া নানা উপলক্ষে ক্ষোভ জমিতেছিল। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ক্ষোভ নিরসনের আশা না থাকিলে অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া জারি হইবার আশঙ্কা থাকে, অন্দরের সমস্যা অন্দরেই না মিটিলে তাহা বাহিরের হাটে আসিয়া পড়ে, সে কথাও সুবিদিত। ক্ষুব্ধ বিচারপতিরা ঠিক করিয়াছেন কি না সেই প্রশ্ন অতএব অমীমাংসিত, কিন্তু অনেক বড় প্রশ্ন: পরিস্থিতি এমন চরমে পৌঁছাইল কী করিয়া।
সংকট অনেক সময়েই সংস্কারের জনক। আশা করা যায়, এই সংকটের অভিঘাতে বিচারবিভাগের পরিচালনার নীতি ও কর্মপদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনের জরুরি কাজটি সম্পন্ন হইবে। প্রাথমিক কর্তব্য অবশ্যই প্রধান বিচারপতির সহিত তাঁহার চার সহকর্মীর মতভেদ নিরসন। প্রতিবাদী বিচারপতিদের কেহ কেহ সেই বিষয়ে আশ্বাস দিয়াছেন। আইনজীবীদের সংগঠনের প্রস্তাব মানিয়া সুপ্রিম কোর্টের সমস্ত বিচারপতির সমবেত আলোচনার আয়োজন হইবে, না প্রধান বিচারপতি সংশ্লিষ্ট চার বিচারকের সহিত আলোচনা করিবেন, অথবা অন্য পথের সন্ধান মিলিবে, তাহা ক্রমশ প্রকাশ্য। তবে পথ যাহাই হউক, তাহা বিচারবিভাগের নিজস্ব পরিসরেই সীমিত থাকা বাঞ্ছনীয়, সরকার বা রাজনৈতিক দলের ছায়াপাত যেন না ঘটে। দুর্ভাগ্যের কথা, দুশ্চিন্তার কথাও বটে, তেমন আশঙ্কা অমূলক নহে। সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী সহ বিভিন্ন মহল হইতে সাম্প্রতিক ঘটনাপরম্পরায় রাজনৈতিক সংস্রবের অভিযোগ উচ্চারিত হইয়াছে। প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁহার সরকার তথা দল এখনও পর্যন্ত গভীর মৌন অবলম্বন করিয়া আছেন বটে, তবে তাঁহার সচিব শনিবার সহসা প্রধান বিচারপতির আবাসের সম্মুখে আবির্ভূত হইয়া যে জল্পনার উপকরণ সরবরাহ করিলেন তাহা স্বাস্থ্যকর নহে— শুভ নববর্ষ জানাইতে জানুয়ারি মাসের তেরো তারিখ অবধি অপেক্ষা করিতে হইল কেন, বুঝ লোক যে জানো সন্ধান!
এই সংকটের সূত্রে বিচারব্যবস্থার সংস্কারের বৃহত্তর প্রশ্নটিও গুরুতর আকার ধারণ করিয়াছে। এ দেশে সর্বোচ্চ আদালত সহ সর্বস্তরে বহু বিচারকের আসন শূন্য। সুপ্রিম কোর্ট ও বিভিন্ন হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া লইয়া কেন্দ্রীয় সরকার ও সর্বোচ্চ আদালতের মধ্যে টানাপড়েন চলিতেছে। বিচারপতি নিয়োগের দায়িত্ব যে কলেজিয়াম বা বিচারকমণ্ডলীর হাতে, বর্তমান বিবাদ তাহার অন্দরমহলেই। সুতরাং বিচারপতি নিয়োগের সামগ্রিক আয়োজনটিই ইহার ফলে সমধিক বিপর্যস্ত হইবে কি না, সেই আশঙ্কা প্রবল। বিশেষত, যাঁহারা বিচারপতি বাছিবেন তাঁহাদের পারস্পরিক আস্থায় টান পড়িলে কলেজিয়াম ব্যবস্থাটির যৌক্তিকতা সম্পর্কে সংশয়ও বাড়িতে বাধ্য। আবার, সরকার তথা রাজনৈতিক দলগুলি এই সংশয়ের সুবাদে দাবি করিতে পারে যে, এই কারণেই বিচারপতি নিয়োগে সরকারের ভূমিকা থাকা আবশ্যক। কী ভাবে বিচারপতি নিয়োগ করা বিধেয়, তাহা তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু সেই তর্ক হওয়া উচিত সুস্পষ্ট নীতির প্রশ্নে, পরিচ্ছন্ন যুক্তির পথে। কলহ ও ক্ষুদ্রস্বার্থের ধৌঁয়াশায় নীতি এবং যুক্তি হারাইয়া যায়। এখন প্রথম কাজ, ধোঁয়াশা দূর করা।