সম্পাদকীয় ২

লেজকাহিনি

দিল্লির এ কে গোপালন ভবনে সদর দফতরটি আছে বটে, কিন্তু সিপিআইএম-এর সর্বভারতীয় উপস্থিতি বিজেপির নারীবাদের ন্যায়— অস্তিত্বহীন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:১১
Share:

দশকে এক বার। বড় জোর। সিপিআইএম-এ এই হারেই ‘বিদ্রোহ’ হয়। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে জ্যোতি বসু ‘ঐতিহাসিক ভুল’-এর দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়াছিলেন। গত দশকে মুখ খুলিয়াছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। আর, এই দশকে সীতারাম ইয়েচুরি। তিনি স্মরণ করাইয়া দিলেন, দলটি এখনও ‘ভারতের’ কমিউনিস্ট পার্টি, শুধুমাত্র কেরলের নহে। অভ্যন্তরীণ বিসংবাদে বামপন্থী নেতাদের যদি বুক ফাটেও, সচরাচর মুখ ফোটে না। দেশের যে কতিপয় মানুষের এখনও সিপিআইএম নামক দলটিকে লইয়া বিন্দুমাত্র আগ্রহ আছে, তাঁহারা দীর্ঘ দিন যাবৎ যে কথাটি বলিতেছিলেন, শেষ অবধি ইয়েচুরিও মুখ ফুটিয়া তাহা বলিয়াই ফেলিলেন। অনুমান করা চলে, তাঁহার, এবং বঙ্গ লবির নিকট পরিস্থিতি একান্তই অসহ হইয়াছিল। তাহাতে আশ্চর্যের কী? প্রকাশ কারাটের বদান্যতায় রাজ্যসভায় পশ্চিমবঙ্গ হইতে এক জনও সাংসদ না থাকিবার ব্যবস্থা পাকা হইয়াছে। তিনি ক‌ংগ্রেসের সাহায্য লইতে নারাজ, এ-দিকে একার ক্ষমতায় রাজ্যসভায় এক জন সাংসদ পাঠাইবার মতো জোরও পশ্চিমবঙ্গে সিপিআইএম-এর নাই। দলটির অবস্থা এমনিতে সুকুমার রায় বর্ণিত ‘হুঁকোমুখো হ্যাংলা’র ন্যায়— ত্রিপুরাকে বাদ রাখিলে দুইটি বই লেজ নাই। কোন লেজে মাছি মারা হইবে, সেই সিদ্ধান্তটি স্বভাবতই দলের অভ্যন্তরে যে রাজ্যের জোর বেশি, সেই রাজ্যই করিয়া থাকে। দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ ছাড়িতে হইলেও নিয়ন্ত্রণের রাশটি যে প্রকাশ কারাট ছাড়েন নাই, কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে তাহা স্পষ্ট হইয়াছে। কেরল লবির স্বার্থরক্ষাই দলের পথের স্বীকৃতি পাইতেছে। সীতারাম ইয়েচুরির ‘বিদ্রোহ’ আর ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। তবে, দেরি হইয়া গেল।

Advertisement

দিল্লির এ কে গোপালন ভবনে সদর দফতরটি আছে বটে, কিন্তু সিপিআইএম-এর সর্বভারতীয় উপস্থিতি বিজেপির নারীবাদের ন্যায়— অস্তিত্বহীন। পশ্চিমবঙ্গ ও কেরল, এই স্মৃতি ও সত্তাই দলের সর্বস্ব— ভবিষ্যতের প্রশ্নটি উহ্য রাখিলেই মঙ্গল। দুইটি রাজ্যের একটিতেও বিজেপি সিপিআইএম-এর প্রধানতম শত্রু নহে। ফলে, খাতায়কলমে যতই বিজেপি-বিরোধিতার রণহুংকার থাকুক না কেন, বাস্তবের সমীকরণগুলি ভিন্ন। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস শত্রু; কেরলে কংগ্রেসের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা। প্রবচনের কুকুরটিকে তাহার লেজ চালনা করে। সিপিআইএম-এর অবস্থা করুণতর— তাহার দুইটি লেজ ক্রমাগত দুই বিপরীত অভিমুখে টানিতেছে। সর্বভারতীয় দল নামক অস্তিত্বহীন শরীরের পক্ষে সেই টান কাহাঁতক সহ্য করা সম্ভব?

সীতারাম ইয়েচুরি তাঁহার বক্তব্যটিকে যেখানে থামাইয়াছেন, প্রকৃত প্রস্তাবে কথা সেখান হইতে শুরু করা বিধেয়। একই সঙ্গে কেরল ও পশ্চিমবঙ্গের দলের স্বার্থরক্ষা করা সিপিআইএম-এর পক্ষে অসম্ভব। এই অবস্থায় দুইটি সমাধান সম্ভব। এক, যখন যে লবির পাল্লা ভারী, দল সেই রাজ্যের স্বার্থরক্ষা করিবে। দ্বিতীয়, পশ্চিমবঙ্গের দল আলাদা হইয়া যাউক। চিনের প্রশ্নে দল ভাঙিবার অপেক্ষা রাজ্যের স্বার্থে ভাঙা ভাল। সিপিআইএম যে নিতান্তই আঞ্চলিক দল, সে বিষয়ে আজ কোনও সংশয় নাই। না হয় এই বার সাইনবোর্ড পৃথক হইবে। কমিউনিস্ট পার্টির পূর্বে একটিতে লেখা থাকিবে পশ্চিমবঙ্গ, অন্যটিতে কেরল।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement