কাহারও সর্বনাশ করিতে চাহিলে নাকি ঈশ্বর প্রথমে তাহার বুদ্ধি কাড়িয়া লন। সিপিআইএম নামক দলটির হাল দেখিলে আশঙ্কা হয়, সর্বনাশের পরেও তিনি বুদ্ধি আর ফিরাইয়া দেন না। দেওয়ালে পিঠ ঠেকিতে ঠেকিতে কোনটি দেওয়াল কোনটি বা পিঠ, তাহা যখন আর চিনিবার উপায় নেই, সেই অবস্থাতেও এই দলের বুদ্ধি ফিরিয়া আসিয়াছে বলিয়া ভরসা হয় না। সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের একটি মন্তব্যে এবং তাহার নিহিত পরামর্শে সিপিআইএমের বিবিধ মহলে যে প্রতিক্রিয়া দেখা এবং শোনা যাইতেছে, তাহাকে অন্তত সুলক্ষণ বলা কঠিন। দীপঙ্করবাবুর অভিমত: গোটা দেশে এবং তাহার গুরুত্বপূর্ণ পরিসর হিসাবে পশ্চিমবঙ্গেও বামপন্থীদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপি, সুতরাং এই রাজ্যের নির্বাচনী রণকৌশল নির্ধারণেও সেই সত্যকে স্বীকার করিয়া চলা দরকার। তিনি এই সত্য অনুসরণের জন্য সিপিআইএমকে তৃণমূল কংগ্রেসের সহিত জোট বাঁধিতে বা কোনও বোঝাপড়া করিতে বলেন নাই, বস্তুত শুরুতেই পরিষ্কার ভাবে জানাইয়া দিয়াছেন যে, তেমন কোনও বোঝাপড়ার কথা তিনি বলিতেছেন না। পরামর্শটি আপেক্ষিক গুরুত্ব নির্ধারণ সংক্রান্ত।
সিপিআইএম নেতারাও সেই গুরুত্বকে অস্বীকার করিতেছেন না, তাঁহারাও বলিতেছেন বিজেপি ভারতীয় গণতন্ত্রের মূল কাঠামোর পক্ষেই বিপজ্জনক, তাহাদের প্রতিহত করিতেই হইবে। কিন্তু তাঁহাদের আশঙ্কা, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে প্রধান প্রতিপক্ষ সাব্যস্ত করিয়া ভোটের লড়াই লড়িতে গেলে তাঁহারা তৃণমূল-বিরোধী ভোট হারাইবেন, সুতরাং এই রাজ্যের লড়াই প্রধানত তৃণমূল কংগ্রেসের সহিত। এহ বাহ্য। নেতৃত্বের এই বিচারধারার ভাব সম্প্রসারণ করিয়া দলের বিভিন্ন স্তরে এবং তাহার সমর্থকদের বৃহত্তর পরিধিতে প্রচার চলিতেছে: রাজ্যের শাসনক্ষমতা হইতে আগে তৃণমূল কংগ্রেসকে সরানো দরকার, তাহাতে যদি বিজেপি আসে আসুক, পরে তাহাদের সহিত লড়াই করিয়া বামপন্থীরা ২০১১ সালের হৃত ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করিবেন। দিকে দিকে এই বার্তা রটিতেছে। দলের নেতারা তাঁহাদের উচ্চাসনে বসিয়া এই ব্যাখ্যা চাহিতেছেন কি না, তাহা গৌণ প্রশ্ন। সিপিআইএম কার্যক্ষেত্রে বিজেপিকে আপেক্ষিক ভাবে লঘু করিয়া দেখিতেছে ও দেখাইতেছে। ইহা একটি বিপজ্জনক ভুল।
এমন ভুল বিচিত্র বটে, তবে অপ্রত্যাশিত নহে। ভারতীয় তথা বঙ্গীয় কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস একের পর এক ঐতিহাসিক ভ্রান্তির কলঙ্কে লাঞ্ছিত। বস্তুত, ভ্রান্তি বলিলে কম বলা হয়, আসলে ইহা ধারাবাহিক নির্বুদ্ধিতার ইতিহাস, যে নির্বুদ্ধিতা স্বদেশ তথা স্বরাজ্যের বাস্তবকে বুঝিতে পারে না, সুতরাং ভুল বুঝে। তাহার সহিত মিশিয়াছে সর্বজ্ঞ পার্টির অপরিমেয় অহঙ্কার, যাহা আত্মশুদ্ধির পথে বিরাট বাধা হইয়া দাঁড়ায়। ‘জনযুদ্ধ’ নীতির ধামা ধরিতে গিয়া ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সক্রিয় বিরোধিতা, সুভাষচন্দ্র বসুকে বিশ্বাসঘাতক তকমা দেওয়া, দেশের স্বাধীনতাকে ‘মিথ্যা’ বলিয়া সদ্যোজাত স্বদেশি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের হঠকারিতা হইতে শুরু করিয়া জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রিত্বের সুযোগ হরণ করিয়া লওয়া— সমস্ত ক্ষেত্রে এই বামপন্থীরা অবলীলাক্রমে দেশের এবং রাজ্যের স্বার্থ বিসর্জন দিয়াছেন। শেষ বিচারে তাহাতে নিজেদেরও ক্ষতি করিয়াছেন। সেই ক্ষতি অবধারিত ছিল— ‘বোকার মরণ’ কথাটি আকাশ হইতে পড়ে নাই। আজ, সঙ্ঘ পরিবারের আগ্রাসনের মুখে দাঁড়াইয়া আবারও সেই একই ব্যাধি প্রকট হইয়া উঠিতেছে। তাঁহারা স্থির করিয়াছেন, নাসিকাগ্রের সীমা ছাড়াইয়া রাজ্য তথা দেশের বৃহত্তর এবং গভীরতর বিপদ দেখিবেন না, দেখাইয়া দিলেও দেখিবেন না। সর্বনাশ সম্পূর্ণ না করিয়া বোধ করি তাঁহাদের ক্ষান্তি নাই।