—প্রতীকী ছবি
চক্রবৎ পরিবর্তন্তে, সুখ এবং দুঃখ। কোভিড-১৯’এর বিশ্ব এই বহুশ্রুত সুভাষিতটিকে আরও এক বার প্রমাণ করিতেছে। বিভিন্ন দেশের শাসকরা যদি এত দিন নাজেহাল হইয়া থাকেন এই কালান্তক অসুখের ঘায়ে, জনস্বাস্থ্য হইতে অর্থনীতিতে বিবিধ পরাজয় ও অনিশ্চয়তায় যদি ব্যতিব্যস্ত হইয়া থাকেন, তবে এত দিনে কড়ায় গন্ডায় তাহা উসুল করিবার সময় আসিয়াছে। টিকা বাহির হইবার সংবাদ এখন আকাশে-বাতাসে। বাজারে করোনার টিকা ব্যবহারের লাইসেন্স পাইতে চলিয়াছে নানা সংস্থা, নিশ্চিত সংবাদ। সংবাদ নিশ্চিত নহে পরবর্তী স্তর বিষয়ে। কিন্তু লক্ষণীয়, সেই অস্পষ্টতা রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলির নিকট যথেষ্ট সুবিধাজনক, এমনকি সুফলদায়ক। অনেক প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাস অনায়াসে জনসমাজে ছাড়িয়া দেওয়া যাইতেছে। কালচক্র আবর্তিত হয় দ্রুত, যথাসত্বর ‘সুখ’টিকে নিষ্কাশন করা জরুরি।
আমেরিকা হইতে বিহার, করোনা-কালে নির্বাচন মানেই টিকা-রাজনীতির রমরমা। টিকা সকলকেই দেওয়া হইবে, বিনাপয়সায় দেওয়া হইবে এবং অচিরেই দেওয়া হইবে, প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ি। ভোট ফুরাইলেও প্রতিশ্রুতি অব্যাহত থাকিয়াছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী এমনকি ‘বিশ্বমানব’-এর জন্য টিকা সরবরাহের কথা বলিয়াছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের মঞ্চে দাঁড়াইয়া। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রতাপ সারঙ্গী আশ্বাস দিয়াছেন, সকলের জন্য ‘বিনা খরচ’-এ কোভিড-১৯’এর টিকা মিলিবে। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বলিয়াছেন, প্রধানমন্ত্রী ‘বিনামূল্যে সকল নাগরিক’-এর টিকার ব্যবস্থা করিবেন। রাজ্য সরকারগুলিও পিছাইয়া নাই। তামিলনাড়ু, মধ্যপ্রদেশ, অসম, পুদুচেরি এবং দিল্লি সার্বিক টিকাকরণের কথা বলিয়াছে— খরচহীন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও সার্বিক টিকাকরণের কেন্দ্রকে সর্ব রকমের সহায়তার কথা বলিয়াছেন। লক্ষণীয়, রাজনৈতিক মহল যেখানে সার্বিক টিকাকরণের প্রতিশ্রুতিতে প্রতিযোগী, বিশেষজ্ঞ মহলের মতামত কিন্তু অন্য রকম। কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্যসচিব স্বয়ং মন্ত্রীদের আশ্বাসের বিপরীতে গিয়া বলিয়াছেন, সরকার সকলের টিকাকরণের কথা বলে নাই, ভুল-বোঝাবুঝি হইয়াছে। অর্থাৎ, মন্ত্রীরা যাহাই বলুন না কেন, সরকারের অন্দরেই সংশয়। সংশয় যথার্থ। প্রথমত, সকলের জন্য ‘বিনামূল্যে’ টিকা বিতরণ সম্ভব কি না, তাহা একটি প্রশ্ন। বেসরকারি টিকার কথাটি এই প্রসঙ্গেই গুরুত্বপূর্ণ। আবার, সকলকে এখনই টিকা বিতরণ কিংবা টিকাকরণ সম্ভব কি না, তাহাও বড় প্রশ্ন। হয়তো বৎসরাধিক কাল লাগিয়া যাইতে পারে। তৃতীয় একটি প্রশ্নও আছে: আদৌ সকলকে টিকা দিবার প্রয়োজন আছে, না কি সংক্রমণ-শৃঙ্খল ভাঙিবার যুক্তিটি ব্যবহার করিলেই প্রত্যাশিত ফল লাভ সম্ভব? আশ্চর্য যে, এত গভীর সংশয়ের পাশেই কিন্তু প্রতিশ্রুতি বিতরণ চলিতেছে, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থ পারস্পরিক সমর্থন জুগাইতেছে।
এক দিকে রাজনীতিকদের অভিপ্রায় এবং ব্যবসার অভিসন্ধি। অন্য দিকে বিজ্ঞানের দায়বোধ। দূরত্ব বিস্তর। কিন্তু কখনও কখনও এই দূরত্ব ভাঙিয়া গভীরতর সমস্যার উদ্ভব হয়। কোভিড-১৯’এর টিকা আবিষ্কারের প্রথম পর্যায় হইতেই বিশ্বময় টিকা-বাজার ও টিকা বিতরণের স্বার্থসন্ধানী প্রলোভন বিজ্ঞানের গবেষণাকে তাড়না করিয়া বেড়াইবার ফল: রেকর্ড সময়ে টিকা আবিষ্কার। টিকার সাফল্যই তাহার কার্যকারিতার প্রমাণ, সুতরাং তাহা এখনও প্রমাণসাপেক্ষ। কিন্তু ইতিমধ্যেই যে টিকা-পর্যটনের হাতছানি এবং টিকা-রাজনীতির আস্ফালন জনসমাজকে গ্রাস করিতে বসিয়াছে, ইহা হইতে বাঁচিবার রাস্তা একটিই। তাহা হইল, জনসাধারণের নিরন্তর সচেতনতা যে টিকা একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। বিজ্ঞানের নিয়ম মানিয়াই টিকার প্রয়োগ হইবে। রাজনীতি বা ব্যবসায়ের নিয়মে নহে।