কেন্দ্র কী করেছে? পরিযায়ী শ্রমিকদের বিষয়টি, দেখেও না দেখার ভান করে ছিল। ছবি: এপি।
দেশব্যাপী লকডাউন চলছে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন জায়গায় বিধিনিষেধে পরিবর্তন হয়েছে। কিছু জায়গায় কঠোর আবার কিছু জায়গায় শিথিল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এখন সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়। প্রায় ২ মাসের কঠিন শারীরিক ও মানসিক যুদ্ধের পরিচয় দিয়েছেন সাধারণ মানুষ। কোভিড-১৯ মহামারির বিরুদ্ধে আসন্ন দীর্ঘ লড়াইয়ে এই অভিজ্ঞতা আমাদের সাহায্য করবে। এই পরিস্থিতি অনেক কিছুই জনসমক্ষে এনেছে, যেমন, সরকারের প্রশাসনিক পরিকল্পনা, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক এবং নাগরিকদের সুরক্ষার্থে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ।
সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন অবশ্যই কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে হতে হবে। রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে কোনও পরামর্শ না করেই চার ঘন্টার নোটিশে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। আমাদের এই সিদ্ধান্তকে কী ভাবে বিচার করা উচিত? আমাদের এই পরিস্থিতিতে কী প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত?
এই ক্ষেত্রে ভাষা অন্যতম সমাধানের সূত্র হতে পারে। যে কোনও প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, সাংস্কৃতিক সংগঠন, রাজনৈতিক দল বা সরকারকে কিছু ট্রেডমার্ক শব্দভাণ্ডার, শব্দ বা বাক্যাংশ যা প্রায়শই ব্যবহৃত হয়, তার দ্বারা শনাক্ত করা যায়। বিজেপি সরকারের ক্ষেত্রে এগুলি হ'ল "মাস্টারস্ট্রোক", "সার্জিক্যাল স্ট্রাইক", "শক ট্রিটমেন্ট" বা "সিক্রেসি"। সুপরিকল্পিত উপায়ে হঠাৎ নাটকীয় ভাবে এগুলি প্রয়োগ করা হয়।
এক দশক আগে, লেখক ও সমাজকর্মী নাওমি ক্লিন একটি বই লিখেছিলেন, যার শীর্ষক "দ্য শক ডক্ট্রিন: দ্য রাইজ অব ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম"। এটি সমাজের পুনর্গঠনের জন্য অসৎ উপায়ে ব্যবহৃত "শক ট্রিটমেন্ট" কীভাবে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে তার বিরুদ্ধে একটি সতর্কতা ছিল। যাঁরা এই "শক ডক্ট্রিন" প্রচার করেন তাঁরা এই সঙ্কটপূর্ণ পরিস্থিতি ও শঙ্কিত জনগোষ্ঠীর অসহায় অবস্থার সুযোগ নেন। তবুও বিশ্বাস কখনই সত্যে পরিণত হয় না। ২৩ মার্চ রাত ৮ টার সময় লকডাউন ঘোষণার পর থেকেই আমি নাওমি ক্লিন এবং তাঁর বইয়ের কথা প্রায়শই ভেবেছি।
আরও পড়ুন: ডাহা ফেল! করোনা কাণ্ডের পর জ্যোতিষীদের কি দিন ফুরলো
এই রকম তো হওয়ার কথা ছিল না। মার্চের প্রথম তিন সপ্তাহ কেন্দ্রীয় সরকার কোনও পদক্ষেপ করেনি। ৫ মার্চ তৃণমূল কংগ্রেস লিখিতভাবে কোভিড-১৯ এর মোকাবিলার জন্য পরিকল্পনা করতে জরুরি ভিত্তিতে সংসদীয় কমিটিগুলিকে বৈঠক করার আহ্বান জানিয়েছিল। একই দিনে বাংলার সরকার ভবিষ্যতের কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য আইসোলেশন ওয়ার্ড তৈরি করা শুরু করে। পরের দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কুইক রেসপন্স টিম গঠন করেন।
কেন্দ্র কিছুই করেনি। একদিকে ভাসা ভাসা ভাবে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু অন্যদিকে নিজেদের দেওয়া সতর্কতাগুলি নিজেরাই উপেক্ষা করছেন। বারংবার সংসদ মুলতুবি করার আবেদন করা সত্ত্বেও তা উপেক্ষা করা হয়েছে। ২ সপ্তাহ ধরে চেষ্টা করার পর, গত ২০ মার্চ অবশেষে হতাশ হয়ে তৃণমূল তাদের দুই কক্ষের সাংসদদের সংসদে যেতে বারণ করে দিয়েছিল। কেন্দ্র লকডাউন ঘোষণা করার আগেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলায় আংশিক লকডাউন চালু করেছিলেন।
আরও পড়ুন: প্রশ্ন এখন, ভাইরাস কি শীতে পালোয়ান, গরমে কাবু?
যেহেতু বিজেপি সরকারের পদক্ষেপ করতে এত দেরি হয়েছিল, তাই স্বভাবতই আশা করা হয়েছিল যে একটি বিস্তারিত ব্লু প্রিন্ট তৈরি থাকবে। যেমন, ভাবা হয়েছিল, পরিযায়ী শ্রমিকদের বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতি থাকবে। গত ২৬ মার্চ, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী অন্যান্য রাজ্যগুলিকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলেন তারা যেন বাংলার আটকে পড়া অতিথি শ্রমিকদের দেখাশোনা করেন। পাশাপাশি তিনি বাংলায় থাকা শ্রমিকদেরও দেখাশোনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এর পর, বাংলার সরকার সারা দেশে আটকে পড়া ৪ লক্ষ শ্রমিককে এক হাজার টাকা করে আর্থিক সাহায্য করেছে। কোনও রকম লোক দেখানো প্রচার না করে।
কেন্দ্র কী করেছে? পরিযায়ী শ্রমিকদের বিষয়টি, দেখেও না দেখার ভান করে ছিল। ওরা রাজ্য সরকারগুলির উপর কর্তৃত্ব ফলানোর জন্য ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট ব্যবহার করেছে অথচ, ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানের মূল নিয়মগুলিকেই উপেক্ষা করেছে। এই প্ল্যানটিতে দুর্যোগের সময় সামাজিক অন্তর্ভুক্তির উপর গুরুত্ব দিয়ে দুর্বল মানুষ, যেমন— তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতি, প্রতিবন্ধী, প্রবীণ, মহিলা ও শিশু এবং অবশ্যই পরিযায়ী শ্রমিক (যাদের মধ্যে অনেকেই অন্যান্য বিভাগের আওতায় রয়েছেন)— এঁদের ভাল থাকার বিষয়টি সুনিশ্চিত করার কথা সুস্পষ্টভাবে বলা আছে।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী তিনটি সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। কোনও বারই কোনও কাজের কথা বলেন নি। মানুষের মর্যাদার প্রতি কোনও রকম সংবেদনশীলতা ছিল না। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে যে সংবিধানের ২১ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জীবনের অধিকার কেবল শারীরিক অধিকার নয়; এর মধ্যে রয়েছে মানুষের মর্যাদার সাথে বেঁচে থাকার অধিকার। অবহেলিত নাগরিকদের, বিশেষত পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করা হয়েছে, তা মানুষের মর্যাদার অবমাননা বলা চলে। এটি বেদনাদায়ক ।
কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টকে বলেছে রাজপথে এবং জাতীয় সড়কে কোনও পরিযায়ী শ্রমিক নেই। আর ঠিক সেই সময়েই সোশ্যাল মিডিয়া (এবং কেবল একটি বা দু’টি সাহসী টেলিভিশন চ্যানেল) ছেয়ে গিয়েছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্লান্ত হয়ে মাইলের পর মাইল হাঁটার ছবি ও ভিডিওতে। পরিযায়ী শ্রমিকদের আন্তঃরাষ্ট্রীয় ভ্রমণের গাইডলাইনগুলি লকডাউনের প্রায় এক মাস পর জারি করা হয়েছে। একেবারে দয়ামায়াহীন।
আওরাঙ্গাবাদের নির্মম রেল দুর্ঘটনার কথা আমরা ভুলিনি। একটি মালগাড়ি ১৬ জন পরিযায়ী শ্রমিককে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল। অন্যান্য লক্ষ লক্ষ মানুষের মতো তাঁরাও সড়কপথে পায়ে হেঁটে তাঁদের গ্রামে ফিরছিলেন। ক্লান্তির ফলে রেললাইনে শুয়েছিলেন তারা। এতটাই ক্লান্ত যে, ট্রেন আসার আওয়াজও শুনতে পাননি। অতিথি শ্রমিক সংক্রান্ত এরকম আরও হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে। এই পর্বতপ্রমাণ সংকটের সময় প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং রেলমন্ত্রীর দেখাই পাওয়া যাচ্ছে না। লক্ষ লক্ষ দরিদ্র অতিথি শ্রমিক আজ পরিত্যক্ত। ভারতীয় রেল দিনে ২.৩ কোটি মানুষের যাতায়াতের ক্ষমতা রাখে। রেলমন্ত্রী চাইলেই এই মানুষগুলিকে কয়েক দিনের মধ্যেই স্থানান্তরিত করা যেত। কিন্তু না।
পয়লা মে থেকে মহা ঢক্কানিনাদের সঙ্গে শুরু হয় পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য বিশেষ ট্রেন পরিষেবা। কিন্তু এক্ষেত্রেও কেন্দ্র পাষাণ হৃদয়ের ছাপ রেখে যায়। পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছ থেকে ট্রেনের ভাড়া উসুল করার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র, এবং সেই ভাড়া সংগ্রহের দায়িত্ব বর্তায় রাজ্যগুলির ওপর। এমতাবস্থায় দায়িত্বপরায়ণতার পরিচয় দিয়েছে রাজ্য সরকারগুলি। কোটা, ভেলোর, চেন্নাই এবং দেশের অন্যান্য জায়গায় আটকে পড়া মানুষকে ঘরে ফেরাতে সমস্ত খরচ বহন করে বাংলা। অকুণ্ঠচিত্তে বাংলায় ফেরানো হয় দেড় লক্ষ মানুষকে। এই পুরো সময়টা রেল মন্ত্রক টাকার হিসেব কষতে ব্যস্ত ছিল। একদিকে তাঁরা বলছিলেন রাজনীতি না করতে, অন্যদিকে রাজ্যগুলিকে দোষারোপ করতেও ছাড়েননি। অবিশ্বাস্য!
কেউ হয়তো ভেবে বসবেন, কেন্দ্র দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে আর রাজ্যগুলি টাকার জোয়ারে ভাসছে। গল্পের গরুকে গাছে ওঠালে হয়তো তাই হবে। হঠাৎ করে লকডাউন ঘোষণা হওয়ার ফলে রাজ্যগুলি কোনও প্রস্তুতি নিতে পারেনি। ফলে, ভাঁড়ে মা ভবানী অবস্থা হয়েছে। উপরন্তু, রাজ্যগুলির ন্যায্য পাওনাও মেটায়নি কেন্দ্রীয় সরকার। কেন্দ্রের কাছে বাংলা মোট ৬১ হাজার কোটি টাকা পায়, যার মধ্যে ৩৬ হাজার কোটি টাকা পুরনো বকেয়া। টাকা আসার কোনও লক্ষণ আপাতত দেখা যায়নি। পেয়েছি শুধু সাংবাদিক বৈঠকে কথার ঝুড়ি। রাজ্যগুলি কীভাবে তাদের বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনরায় দাঁড় করাবে? ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য অর্থ কে প্রদান করবে? কেন্দ্র তো হাত তুলেই দিয়েছে।
আমি কয়েকটি পুঙ্খানুপুঙ্খ উদাহরণগুলো দিলাম— কোভিড পরিস্থিতি সম্পর্কে বিলম্বিত বোধোদয় এবং প্রস্তুতিতে ঢিলেমি; পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্ভোগ অবহেলা করা; জীবনের চেয়ে বেশি মূল্যবান অর্থ; এমনকি ন্যূনতম এবং অত্যাবশ্যক কল্যাণমূলক কর্মসূচির জন্য রাজ্যগুলিকে সমর্থন না করা; ভদ্র, কঠোর পরিশ্রমী ও সমস্যার সম্মুখীন সাধারণ মানুষের মর্যাদাকে উপেক্ষা করা।
আমি আরও অনেক কিছুই বলতে পারি, আরও অনেক উদাহরণ দিতে পারি—পরীক্ষার সরঞ্জাম (যেমন কিট) সংগ্রহ না করা এবং রাজ্যগুলিকে সংগ্রহ করার অনুমতি না দেওয়া; অবশেষে এমন কিট পাঠানো যা কাজ করে না এবং প্রত্যাহার করতে হয়; রাজ্যগুলিকে ধমকানো এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর অবমাননা; কোনও ব্যাখ্যা না দিয়ে, কোনও রকম পরামর্শ ব্যতিরেকে এবং কোনও অধ্যাদেশ বা আইনি বিধান ছাড়াই একটি কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং অ্যাপ্লিকেশন চালু করা ইত্যাদি।
এই সব বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে জবাব দিতে হবে। জবাব দিতে তারা বাধ্য। কারণ, গণতন্ত্রে দায়িত্বশীলতার কোনও লকডাউন হয় না।
লেখক: তৃণমূলের রাজ্যসভার দলনেতা।