প্রতীকী ছবি।
তালাবন্ধ দেশে বাঁচিতে হইলে কোন কোন সামগ্রী অত্যাবশ্যক? লকডাউনের প্রথম পর্ব অতিক্রমের পরই জীবন ও জীবিকাকে সুরক্ষিত রাখিবার স্বার্থে সরকার বিভিন্ন ‘অত্যাবশ্যক সামগ্রী’তে ছাড়ের কথা ঘোষণা করিয়াছিল। লকডাউন যত অগ্রসর হইয়াছে, সেই ছাড়ের, অর্থাৎ অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রীর তালিকা ক্রমশ বৃদ্ধি পাইয়াছে। কিন্তু অত্যাবশ্যক পণ্যের তালিকা তৈরির সময় সরকার মেয়েদের কথা বেমালুম ভুলিয়াছে। ফুল, মিষ্টির সরবরাহ অব্যাহত রাখিবার কথা সরকারের স্মরণে আছে, কিন্তু স্যানিটারি ন্যাপকিন লইয়া বিশেষ ভাবনাচিন্তা করা হয় নাই। আদৌ ইহা অত্যাবশ্যক তালিকাভুক্ত হইবে কি না, ধোঁয়াশা রহিয়াছে তাহা লইয়াও। পরিণতি স্পষ্ট— দেশে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে, ন্যাপকিনের সঙ্কট তীব্র হইয়াছে। অবস্থা এতই শোচনীয় যে, মেয়েরা পুনরায় কাপড় ব্যবহারের অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসে ফিরিতেছে।
এই উদাসীনতা অবশ্য নূতন নহে। ২০১৭ সালে বিজেপি-র সরকারের হাত ধরিয়া ভারতে যখন জিএসটি-যুগ শুরু হইল, তখন স্যানিটারি ন্যাপকিনের উপর ১২ শতাংশ কর আরোপ করা হয়। ন্যাপকিনকে সেই সময়ও ‘অত্যাবশ্যক’ নহে, বরং ‘শৌখিন’ সামগ্রী হিসাবে গণ্য করা হইয়াছিল। অথচ, বহু পূর্ব হইতেই বিভিন্ন সমীক্ষায় বলা হইয়াছে, এই দেশে মেয়েদের স্কুলছুট হইবার প্রবণতার পিছনে ঋতুকালীন সমস্যা এবং শৌচাগারের অভাব অন্যতম প্রধান কারণ। দেশে প্রায় ৭০ শতাংশ মেয়েই অধিক দামের কারণে ন্যাপকিন ব্যবহারের সুযোগ পায় না। কম খরচে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে ন্যাপকিনের জোগান নিশ্চিত না করা হইলে মেয়েদের বিদ্যালয়-বিমুখতা বৃদ্ধি পাইবে এবং চাকুরির বাজারেও তাহারা পিছাইয়া পড়িবে। কিন্তু জিএসটি নির্ধারণের সময় ‘বেটি বচাও বেটি পঢ়াও’-এর প্রবক্তারা সেই সমীক্ষাজাত ফলকে আমল দেন নাই। প্রায় এক বৎসরব্যাপী তীব্র প্রতিবাদ, আবেদন এবং মামলার পথ পার হইয়া অবশেষে স্যানিটারি ন্যাপকিনকে সম্পূর্ণ করমুক্ত ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী কালে গণশৌচাগারগুলিতে ন্যাপকিন মজুত রাখিবার নিয়মটিও আসিয়াছে গণদাবি এবং আন্দোলনের পথ ধরিয়া। যে সরকার শৌচালয় গড়িয়া তুলিবার উপর জোর দেয়, সেই সরকারই মেয়েদের ঋতুকালীন স্বাস্থ্যরক্ষার বিষয়টিকে শৌখিনতা বলিয়া উড়াইয়া দেয়। নিদারুণ পরিহাস।
এই উদাসীনতা আসলে ভারতীয় সমাজের মজ্জাগত, মেয়েদের নিজস্ব সমস্যাগুলিকে লঘু করিয়া দেখিবার প্রবণতা। মনোভাবটি যেন: যখন বাহিরে যাইবার প্রয়োজন নাই, তখন ঘরোয়া উপায়ে সমাধান খুঁজিলেই হয়। যেমন, বহু ক্ষেত্রে বলা হয়, স্বামীর হাতে প্রহৃত হওয়া নিতান্তই ঘরোয়া সমস্যা, ঘরের গণ্ডির ভিতরই তাহা মিটাইয়া ফেলিতে হয়। সমস্যা হিসাবে গার্হস্থ্য হিংসার সঙ্গে ঋতুকালীন সমস্যার তুলনা চলে না, কিন্তু উভয় ক্ষেত্রে মানসিকতাটি একই সূত্রে বাঁধা। ঋতুমতী মেয়েদের লইয়া সমাজের রক্ষণশীলতা এখনও ঘুচে নাই। অল্পশিক্ষিত পরিবারে ইহা এখনও ‘অপবিত্রতা’র শামিল। সচেতনতা প্রচার এবং স্থানীয় ভাবে নির্মিত স্বল্পমূল্যের ন্যাপকিনের সহজলভ্যতার কারণে কিছুটা আশার আলো জাগিয়াছিল। ইহাও যে একটি স্বাস্থ্যসমস্যা, সেই বোধের উন্মেষ ঘটিতেছিল। লকডাউন সেই প্রক্রিয়ায় জল ঢালিয়া ঋতুমতী মেয়েদের ফের অন্ধকারে ঠেলিয়া দিল।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)