তৃতীয় প্লেগ অতিমারি ভারতে পৌঁছেছিল ১৮৯৬ সালে।
ভারতে মহামারি আইনটি রচিত পাশ হয়েছিল ১৮৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। অবিলম্বে আইনটি রচনা করা ছাড়া উপায়ান্তর ছিল না বলেই। উনিশ শতকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে একটি হল তৃতীয় প্লেগ অতিমারি। তৃতীয়, এই হিসেবটি অবশ্য নিতান্তই ইউরোপীয়। খ্রিষ্টাব্দ ষষ্ঠ শতকের প্লেগ অব জাস্টিনিয়ন, চতুর্দশ শতকের ব্ল্যাক ডেথ-এর পর উনিশ শতকে ফের অতিমারিতে আক্রান্ত হয়েছিল ইউরোপ। তাই এর নাম তৃতীয় প্লেগ অতিমারি।
এই অতিমারিরও শুরু চিনে। অনেকের মতে, সেখান থেকেই বাণিজ্য-জাহাজের সংক্রমিত ইঁদুরের মাধ্যমে তা পোঁছায় বম্বে বন্দরে। এই প্লেগ ভারতে পৌঁছেছিল ১৮৯৬ সালে। তখন থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে শুধু ভারতেই প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন অন্তত এক কোটি মানুষ। রোগ সংক্রমণের প্রথম বছরে তৎকালীন বম্বে শহরে মানুষের মৃত্যুহার ছিল সপ্তাহে প্রায় ১,৯০০। পরে তা ছড়ায় কলকাতা, করাচি ও অন্যত্র। এই প্রসঙ্গে আর একটা হিসেবের কথা উল্লেখ করা জরুরি— ভারত বাদে দুনিয়ার সব দেশ মিলিয়ে এই প্লেগে মৃত্যু হয়েছিল ত্রিশ লক্ষ মানুষের।
বাণিজ্যপথ বন্ধ করতে অনীহা দেখিয়ে রাজদণ্ডধারী ব্রিটিশ শাসকরা প্রশ্রয় দিয়েছিলেন বণিকের মানদণ্ডকে। বলেছিলেন, ভারতীয়দের জীবনযাত্রার ধরনই অস্বাস্থ্যকর, নোংরা। এই রোগ ছড়ানোর সবচেয়ে বড় কারণ যে জাহাজে আসা ইঁদুর, এই কথাটি ঔপনিবেশিক শাসকরা স্বীকার করেননি আদৌ। অতএব সর্বত্র ছড়াতে প্লেগের দেরি হল না। অবস্থা দেখে তাড়াহুড়ো করে গৃহীত হল দুর্দম ‘এপিডেমিক ডিজ়িজ় অ্যাক্ট অব ১৮৯৭’, যাতে শাসক ও প্রশাসনিক কর্তাদের দেওয়া হল কার্যত অবাধ স্বাধীনতা। কোভিড-১৯’এর ক্ষেত্রে যেমন হয়েছে, তখনও তেমনই মাজিক দূরত্ব ও ‘সঙ্গরোধ’ জাতীয় ব্যবস্থা নেওয়া হল। সেই ব্যবস্থা ছিল আইনি। ব্যবস্থার রূপায়ণে ছিল ঔপনিবেশিক শাসকের চরম দমননীতি।
তখনও ধর্ম ও জাতিগত গোঁড়ামি, কুসংস্কারের নাগপাশে ভারত কাতর। সেই সময়ে এই ব্যবস্থায় ভারতবাসীর, বিশেষত বম্বেবাসীদের, প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল? মহারাষ্ট্রে উনিশ শতকের প্রথমেও ছিল মরাঠা পেশোয়ার রাজত্ব। মাহার, মং বা চামারদের ছায়াও ছিল অস্পৃশ্য। পুণে গেটের ভিতরে সকাল ন’টার আগে আর বেলা তিনটের পর ছায়া দীর্ঘতর থাকে বলে তাঁদের ঢোকা ছিল নিষিদ্ধ।
এই সামাজিক প্রেক্ষাপটে গৃহীত ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার কথা শাসকের তরফে প্রজাকে বোঝানো দরকার ছিল। কিন্তু সংবেদনশীলতাকে পিষে গৃহীত ব্যবস্থাগুলি ছিল: বলপূর্বক বাড়িতে ঢোকা, পরীক্ষায় বাধ্য করানো, রোগী বা সম্ভাব্য রোগীকে বলপূর্বক পৃথকীকরণ বা হাসপাতালে ভর্তি, সন্দেহ হলেই ‘আনফিট ফর হিউম্যান হ্যাবিটেশন’ ছাপ দিয়ে বাড়িটিকে ধ্বংস করা ইত্যাদি। অনুসন্ধানীদের দলে থাকতেন শুধু তিন জন গোরা সৈনিক এবং এক জন দেশি দোভাষী। মহিলাদের ক্ষেত্রে পর্যন্ত বাহুসন্ধি এবং উরুসন্ধির স্ফীতি পরীক্ষায় শালীনতা ছিল না। শিবিরে, হাসপাতালে, রেল-যাতায়াতে চরম অব্যবস্থা। ছিল বিভেদমূলক আচরণও— অভিজাতদের ক্ষেত্রে ছিল ছাড়।
জনগণের প্রতিক্রিয়াও ছিল ভারতের তৎকালীন সামাজিক-ধর্মীয়-সংস্কৃতিগত অবস্থান এবং দমননীতির ফসল। সিন্ধিয়া দেশমুখ-এর ‘দ্য বম্বে প্লেগ’ (১৮৯৬-'৯৭) রচনায় দেখা যায়— জৈন, ভাটিয়া এবং বনিয়ারা, যাঁরা মান্ডি এলাকার 'চাল' বা ঘনবসতির সস্তার দালানে থাকতেন, ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে ইঁদুর মারতে বাধা দিয়েছিলেন। হিন্দু হাসপাতালে অস্পৃশ্যতার মান্যতা ছিল। হাসপাতালটি বন্ধ করায় ক্ষোভ জন্মেছিল। বাল গঙ্গাধর তিলকের ‘কেশরী’ সংবাদপত্রের ১৮৯৭ সালের একটি বর্ণনায় জানা যায় যে শূদ্রের ছোঁয়ার আশঙ্কায় এক ব্রাহ্মণ শুধু দুধ খেয়ে থাকতেন। ভিন্ জাতের হাতে মরদেহ ব্যবচ্ছেদের ব্যবস্থাতেও জমছিল ক্ষোভ। প্লেগের টিকা নিয়ে গুজব ছিল, তাতে বন্ধ্যাত্ব অবশ্যম্ভাবী। সংশয় কাটাতে এগিয়ে আসেন আগা খান, বাল গঙ্গাধর তিলকরা।
সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছিল শাসকের বলপ্রয়োগ। ফলে, বিক্ষোভও বাড়ছিল। রোগীদের মেরে ফেলতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এমন গুজব শুনে ১৮৯৬ সালে আর্থার রোডের হাসপাতালে হামলা চালান মিলশ্রমিকেরা। বাসস্থান ভেঙে দেওয়ার প্রতিবাদে শ্রমিকদের উদ্যোগে দু’বার ধর্মঘট হয়েছিল ১৮৯৭ সালে। ১৮৯৮ সালে মদনপুরার শ্রমিক আবাসন থেকে মুসলিম তাঁতশ্রমিকের মেয়েকে জবরদস্তি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে হাঙ্গামায় ছিলেন হিন্দু ও মুসলমান শ্রমিকরা। ১৮৯৭-এর ২২ জুন দমনপীড়নের প্রতিবাদে চাপারকার ভাইদের বন্দুকের গুলিতে প্রাণ দেন প্লেগ কমিশনার রান্ড।
আজকের এই অতিমারি-বিধ্বস্ত সময়ে দাঁড়িয়ে সওয়া শতক আগেকার অবস্থার সঙ্গে অনেক রকম মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, এই কথাটা কিন্তু আশ্বস্ত হওয়ার মতো নয়।