শূন্যে পৌঁছলেও অনেক
Coronavirus

অর্থব্যবস্থাকে বাঁচাতে হলে সরকারের খরচ কত বাড়াতে হবে

এই অবস্থায় অর্থনীতির রক্ষাকর্তা হতে পারে শুধুমাত্র সরকারি ব্যয়। সরকার খরচ করলে তবেই দেশে মোট চাহিদার পরিমাণ বাড়বে। 

Advertisement

সুরজিৎ দাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ মে ২০২০ ০১:৩১
Share:

প্রতীকী ছবি

গোটা দুনিয়াতেই আর্থিক বৃদ্ধির হার জোর ধাক্কা খেতে চলেছে। ভারতেও। এই অবস্থায় অর্থনীতির স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য সরকার যথেষ্ট উদ্যোগী না হলে বেকারত্বের হার বাড়বে, দারিদ্র তীব্রতর হবে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমলে দেশে মোট ভোগব্যয়ের পরিমাণও অনেকখানি কমবে। বাজারে চাহিদা না থাকলে জোগানও কমবেই। লাভের প্রত্যাশিত হারের পরিমাণ কমবে, ফলে দেশের জিডিপি-র অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণও কমবে। এই অবস্থায় অর্থনীতির রক্ষাকর্তা হতে পারে শুধুমাত্র সরকারি ব্যয়। সরকার খরচ করলে তবেই দেশে মোট চাহিদার পরিমাণ বাড়বে।

Advertisement

কোভিড-১৯ অতিমারির সংক্রমণ ঠেকাতে যে লকডাউন চলছে, তার ধাক্কায় ভারতীয় অর্থব্যবস্থার কতখানি ক্ষতি হবে, সেই হিসেবটা কষা যাক। সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিস অর্থাৎ সিএসও-র দেওয়া দ্বিতীয় অগ্রিম হিসেবের খাতা থেকে দেখা যাচ্ছে, বর্তমান মূল্যস্তরে ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে ভারতের জিডিপি হওয়ার কথা ২০৪ লক্ষ কোটি টাকা। তার ৬০.২% হল ব্যক্তিগত ভোগব্যয়, ১১.৮% সরকারি ব্যয়, ৩০.৩% বিনিয়োগ, রফতানি ১৮.৭% ও আমদানি ২১.৪%। সিএসও-র পরিসংখ্যানে এক লক্ষ কোটি টাকার হিসেব মেলেনি, অর্থাৎ সংখ্যাতত্ত্বগত গরমিল হল জিডিপি-র ০.৫%।

লকডাউনের ফলে জিডিপি-র গায়ে কতখানি ধাক্কা লাগবে, সেটা এই পরিসংখ্যান থেকে হিসেব করে নেওয়া যায়। কিন্তু, তার আগে দুটো কথা বলে রাখা প্রয়োজন। এক, লকডাউনের তৃতীয় দফায় অর্থনীতির কিছু ক্ষেত্রে কাজ হচ্ছে, কিছু ক্ষেত্রে হচ্ছে না। ফলে, এই দফার নিখুঁত হিসেব কষা মুশকিল। কাজেই, আমরা ৩ মে অবধি ৪০ দিনের হিসেব দেখব। দ্বিতীয়ত, জিডিপি-র অঙ্কে মরসুমি ওঠাপড়া থাকে— বছরের কিছু সময়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিমাণ বাড়ে, কিছু সময়ে কমে। হিসেবের সুবিধার জন্য আমরা এই ওঠাপড়াটাকে বাদ দেব।

Advertisement

বছরে জিডিপি ২০৪ লক্ষ কোটি টাকা হলে, গড়পড়তা হিসেবে ৪০ দিনে হওয়ার কথা ২২.৫ লক্ষ কোটি টাকা। লকডাউনের ফলে ব্যক্তিগত ভোগব্যয় কমেছে— ধরে নিই, কমে তা এক-তৃতীয়াংশ হয়েছে। অর্থাৎ, এই ৪০ দিনে ভোগব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬.৫ লক্ষ কোটি টাকায়, স্বাভাবিকের চেয়ে ৯ লক্ষ কোটি টাকা কম। লকডাউন চলাকালীন কেউ নতুন কোনও বিনিয়োগ করেছেন, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। ফলে, ৪০ দিনে স্বাভাবিকের তুলনায় বিনিয়োগ কম হয়েছে অন্তত ৬.৭৫ লক্ষ কোটি টাকা। যেহেতু এই সময়ে আমদানি আর রফতানি, দুটোই কমেছে, কাজেই ধরে নিচ্ছি যে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ অপরিবর্তিত আছে। এবং, সরকারি ভোগব্যয়ও হয়েছে স্বাভাবিক হারেই। তা হলে, ৪০ দিন লকডাউনের ফলে জিডিপি-র মোট ক্ষতি হল ১৬ লক্ষ কোটি টাকার কাছাকাছি। অর্থাৎ, ভারতের বর্তমান জিডিপি-র ৮ শতাংশের সমান।

১৯৯০-৯১ থেকে ২০১৮-১৯ অবধি জিডিপি পরিসংখ্যান এবং বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের সম্মিলিত ব্যয়ের হিসেব থেকে দেখা যাচ্ছে, সরকারি ব্যয়ের ইলাস্টিসিটি হল ০.৯৬। আবার, ২০১৮-১৯ সালের হিসেবে আমরা দেখেছি, সরকারি ভোগব্যয় হল জিডিপি-র ২৮.২%। অতএব, ভারতে সরকারি ভোগব্যয়ের মাল্টিপ্লায়ার হল ৩.৪, অর্থাৎ সরকার যদি ভোগব্যয়ে এক লক্ষ কোটি টাকা বাড়তি খরচ করে, তবে জিডিপি বাড়বে ৩.৪ লক্ষ কোটি টাকা। এখন দেখার, জিডিপি-র বৃদ্ধির হার কোথায় রাখার জন্য সরকারকে কত টাকা খরচ করতে হবে।

জিডিপি-র প্রকৃত বৃদ্ধির হার নির্ভর করে দুটো জিনিসের ওপর— এক, টাকার অঙ্কে জিডিপি-র বৃদ্ধির হার; দুই, মূল্যবৃদ্ধির হার। আমি একটা হিসেব কষেছি, যাতে দেখা যাচ্ছে, এই অর্থবর্ষে মূল্যবৃদ্ধির হার যদি দুই শতাংশে থাকে এবং টাকার অঙ্কে জিডিপি-ও যদি দুই শতাংশ বাড়ে— অর্থাৎ, জিডিপি-র প্রকৃত বৃদ্ধির হার যদি শূন্যে আটকে রাখতে চাই, তার নীচে নেমে যেতে দিতে না চাই— তা হলে, সরকারকে বাড়তি ব্যয় করতে হবে ৫.৮৮ লক্ষ কোটি টাকা। জিডিপি-র ২.৯৪ শতাংশ। আর, যদি ৩ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি ধরে নিয়ে অর্থনীতির প্রকৃত বৃদ্ধির হার পাঁচ শতাংশে নিয়ে যেতে হয়— কোভিড-১৯ অতিমারির ধাক্কা লাগার আগে ভারতীয় অর্থনীতি যে হারে বাড়বে বলে অনুমান করা হচ্ছিল— তা হলে সরকারকে ৯.৪১ লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় বাড়াতে হবে। জিডিপি-র ৪.৭১ শতাংশ। এই দুটো হল আমার হিসেবের দু’প্রান্তে থাকা সংখ্যা। শূন্য থেকে পাঁচ শতাংশ, জিডিপি-র বৃদ্ধির হারকে তার মধ্যে যেখানে রাখতে চাইবে সরকার, সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে সেই হিসেবেই।

অর্থাৎ, সরকার যদি এই মুহূর্তে দশ লক্ষ কোটি টাকার (জিডিপি-র ৫ শতাংশ) স্টিমুলাস প্যাকেজ ঘোষণা করে, তা হলে টাকার অঙ্কে জিডিপি-র বৃদ্ধির হার হতে পারে ৯%। এই অর্থবর্ষে মূল্যবৃদ্ধির হার যদি ৪% হয়, তা হলে জিডিপি-র প্রকৃত বৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ৫%। মূল্যবৃদ্ধির হার যদি আরও কমে— ৩% হয়— তা হলে জিডিপি-র প্রকৃত বৃদ্ধির হার হবে ৬%। হিসেবটা মাথায় রাখা ভাল, কারণ ইতিমধ্যেই বেশ কিছু দেশ বিপুল অঙ্কের স্টিমুলাস প্যাকেজ ঘোষণা করে দিয়েছে— যেমন, জাপানে জিডিপি-র ২১%, কানাডায় ৮.৮%, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১১%, অস্ট্রেলিয়ায় ৯.৯% ইত্যাদি।

এত টাকা আসবে কোথা থেকে? লকডাউন ও আর্থিক মন্দার কারণে সরকারের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ কমবেই। সেই পরিস্থিতিতে সরকার যদি ভোগব্যয় বৃদ্ধির পথে হাঁটে, তা হলে রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ বাড়বে। এই অর্থবর্ষে কেন্দ্র ও সব রাজ্য সরকার মিলিয়ে তা জিডিপি-র সাড়ে বারো শতাংশে দাঁড়াবে— এখন যেটা নয় শতাংশ। রাজকোষ ঘাটতি বাড়লে ভারতের ক্রেডিট রেটিং কমবে বলে অনেকেই চিন্তিত। বৃদ্ধির হার কমলেও ক্রেডিট রেটিং কমবে, মানুষের দুর্ভোগও বাড়বে।

বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলো কি সরকারকে এই পরিমাণ টাকা ধার দিতে চাইবে? সেটা নির্ভর করবে ব্যাঙ্কগুলোতে মোট আমানতের কত শতাংশ তারা বাজারে ধার দিতে পারছে, তার ওপর। লকডাউন ওঠার পর ব্যাঙ্কে ঋণের চাহিদা কমবে, কারণ বাজারে মোট চাহিদা যখন তলানিতে, তখন কোনও শিল্পপতিই নতুন বিনিয়োগ করতে চাইবেন না। আবার, ব্যাঙ্কে আমানতেও টান পড়বে, কারণ সার্বিক ভাবে মানুষের আয়ের পরিমাণও কমবে।

বাকি টাকার জন্য সরকার রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের দ্বারস্থ হতে পারে। রিভার্স রেপো আর রেপো রেট নিয়ে খুটখাট না করে এই কোভিড-বিধ্বস্ত সময়ে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের কর্তব্য হল, কেন্দ্রীয় সরকারকে জিডিপি-র চার থেকে পাঁচ শতাংশের সমপরিমাণ টাকা ধার দেওয়া। ২৪ এপ্রিলের হিসেব হল, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের তহবিলে মোট ৩৬.৭ লক্ষ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আছে— ৪৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার— জিডিপি-র ১৮%। এই কঠিন সময়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে, সার্বিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ককে যদি তার তহবিল থেকে সরকারকে দশ লক্ষ কোটি টাকা ধার দিতে হয়, তাতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। প্রশ্ন হল, এই বিপুল পরিমাণ টাকা অর্থব্যবস্থায় ঢুকলে মূল্যস্ফীতি হবে কি? সে সম্ভাবনা আপাতত নেই, কিন্তু যদি অতিচাহিদার ফলে মূল্যস্ফীতি হয়ও, তাকে সামলাতে হবে জোগান বাড়িয়ে, চাহিদা খর্ব করে নয়।

ভারতে স্বাস্থ্যখাতে খরচ হয় জিডিপি-র এক শতাংশেরও কম। সরকারি ব্যয় বাড়ানোর সময় স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়িয়ে জিডিপি-র অন্তত তিন শতাংশ করতে হবে। টাকা খরচ করা উচিত ৪০ দিন লকডাউনের ফলে সাধারণ মানুষের রোজগারের ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার কাজেও। নগদ হস্তান্তরের পথে হাঁটতেই হবে, বিশেষত গরিব মানুষদের ক্ষেত্রে। লকডাউনের ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত ন্যূনতম মজুরির হারে— গ্রামে কৃষিশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি প্রতি দিন ৩৫০ টাকা, শহরে শিল্পশ্রমিকদের ক্ষেত্রে তা ৪৫০ টাকা। এই টাকা যে শুধু গরিব মানুষকে বাঁচিয়ে রাখারই কাজ করবে, তা নয়— তাঁরা এই টাকা খরচ করার ফলে লকডাউন-উত্তর পর্বে বাজারে সার্বিক চাহিদা বজায় থাকবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোগকে নতুন করে ব্যবসা আরম্ভ করার জন্য সব রকম সাহায্য দিতে হবে। জাতীয় কর্মসংস্থান যোজনা প্রকল্পকে শহরাঞ্চলেও নিয়ে আসা প্রয়োজন— এবং, এই প্রকল্পে গ্রামে ও শহরে যথাক্রমে কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে ন্যূনতম মজুরির হারে মজুরির ব্যবস্থা করতে হবে। এখন শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় হয় জিডিপি-র মাত্র তিন শতাংশ— তাকে বাড়িয়ে পাঁচ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে।

যে খাতগুলোর কথা বললাম, সেগুলো মূলত রাজ্য সরকারগুলোর হাতে। ফলে, এখন রাজ্যের হাতে বেশি টাকা দেওয়া দরকার। কেন্দ্রীয় সরকার যদি অবিলম্বে সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ জিডিপি-র অন্তত তিন শতাংশ না বাড়ায়, আশঙ্কা যে ২০২০-২১ অর্থবর্ষে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার বৃদ্ধির হার শূন্যের নীচে নেমে যাবে। এই হিসেব ৪০ দিন লকডাউনের কথা মাথায় রেখে কষা। লকডাউন আরও বেড়েছে, ফলে বিপদও গভীরতর হয়েছে বলেই আশঙ্কা।

অর্থনীতি বিভাগ, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement