ছবি পিটিআই
রেললাইনের উপর ইতস্তত ছড়াইয়া আছে আধপোড়া রুটি, দৃশ্যটি দেখিয়া কাঁপিয়া উঠিয়াছে দেশ। ওগুলি যাঁহাদের শেষ সম্বল ছিল, তাঁহারা এখন অসীমের যাত্রী। রেললাইন ধরিয়া হাঁটিয়া ঘরে ফিরিবার মরিয়া চেষ্টা মাঝপথেই শেষ করিয়াছে ভোরের মালগাড়ি। এমন নিত্য ঘটিতেছে। কেহ ট্রাক উল্টাইয়া, কেহ ট্রাক চাপা পড়িয়া, কেহ পথশ্রমে ও ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হইয়া মরিতেছেন। লকডাউনের দেড় মাস কাটিল, ইহার মধ্যে ঘরে ফিরিবার পথে প্রাণ হারাইয়াছেন ষাট জনেরও বেশি পরিযায়ী শ্রমিক। প্রশ্ন উঠিতে বাধ্য, এই মানুষগুলির প্রতি সরকারের কি কোনও কর্তব্যই ছিল না? ইহাদের জন্য সময়োপযোগী পরিকল্পনা করিলে এমন পরিস্থিতি কি এড়ানো যাইত না? অতর্কিতে লকডাউন ঘোষণা করিবার অর্থ, শ্রমিকদের দীর্ঘ দিন প্রবাসে আটকাইয়া থাকিতে হইবে। অর্থাভাব ও খাদ্যাভাব তীব্র হইলে তাহারা ঘরে ফিরিতে অস্থির হইবে, অতএব শ্রমিকদের প্রবাসেই ঘরবন্দি রাখিতে হইলে অর্থ ও অন্নের ব্যবস্থা করিতে হইবে। আর ফিরাইতে হইলে সংক্রমণ ছড়াইবার সম্ভাবনা প্রতিরোধ করিয়া শ্রমিকদের পরিবহণ, কোয়রান্টিন ও বাসস্থানে পুনর্বাসনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করিতে হইবে। ভারতে পরিযায়ী শ্রমিক অন্তত ৯০ লক্ষ, তাহার অর্ধেকও প্রবাসে থাকিলে ব্যবস্থার পরিমাপ কেমন হইবে, তাহার আন্দাজ কঠিন নহে। ইহার মধ্যে অজানা বা অপ্রত্যাশিত কিছু নাই। অথচ কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, ভিনরাজ্যে বন্দি শ্রমিকদের কে খাদ্য জুগাইবে, ব্যয়-বণ্টন হইবে কী উপায়ে, জরুরি ভিত্তিতে অনুদান কী করিয়া পৌঁছাইবে, সে বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরব থাকিল কেন্দ্র। তাহার পরেও কী বিধিতে ট্রেন-বাস চলিবে, কোন নিয়মে যাত্রীদের অগ্রাধিকার নির্ণয় হইবে, তাহার রূপরেখা স্পষ্ট করা হইল না। রাজ্যগুলি শ্রমিক ফিরাইবার বিষয়ে এক এক রকম সিদ্ধান্ত লইবার ফলে শ্রমিকদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও ব্যাকুলতা ছড়াইবার সুযোগ পাইল। প্রাণের ঝুঁকি লইয়া অচেনা পথে গৃহের দিকে যাত্রা তাহারই পরিণাম। নির্বাচিত, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকার নাগরিকের চরম দুর্ভোগের প্রতি এতটা উদাসীন হইল?
সর্বাধিক পীড়াদায়ক এই যে, কোনও রাজ্যেও পরিযায়ী শ্রমিকের প্রতি আশ্বাস বর্ষিত হইল না। শুধু কেরল রাজ্যে আগত শ্রমিকদের অতিথি অভিহিত করিয়া তাহাদের খাদ্য-বাসস্থানের ভার গ্রহণ করিয়াছে। অপর রাজ্যগুলিতে কর্মী শ্রমিক পরিণত হইয়াছে কৃপাপ্রার্থীতে। তাহাদের খাদ্যের অধিকার, চিকিৎসার অধিকার-সহ সকল অধিকারই অবজ্ঞা করিয়াছে রাজ্য। ইহা মহামারি প্রতিরোধের বিধি নহে, ইহা প্রশাসনিক গাফিলতি, তাই লকডাউন দিয়া নাগরিকের খাদ্যবঞ্চনার ব্যাখ্যা করা চলিবে না। আবার ট্রেন চালু হইতে সেই ভিক্ষুকই রাতারাতি পরিণত হইলেন উপভোক্তায়। ভাড়া না গনিয়া তাহার ট্রেনে উঠিবার জো রহিল না। বরং রোগ পরীক্ষা এবং পুলিশি ছাড়পত্র পাইবার বিচিত্র (অ)নিয়ম চলিতেছে, তাই বিশৃঙ্খলা ও দুর্নীতির মুক্তিক্ষেত্র তৈরি হইয়াছে। শ্রমিকরা তাহার সহজ শিকার।
বৎসর দুই আগে মহারাষ্ট্রে চাষিদের মহামিছিল ভারতে রাজনীতির স্বরূপ দেখাইয়াছিল। সে দিন চাষির পায়ের ফোস্কা দেখিয়া শিহরিয়া উঠিয়াছিল দেশ। আজ পরিযায়ী শ্রমিকের ঘরে ফিরিবার যাত্রা যেন আরও লজ্জাজনক, কলঙ্কময়। প্রসঙ্গত, সেই দিনের মিছিলে প্রতিবাদ ছিল, ধিক্কার ছিল। আজিকার এই ক্লান্ত পদযাত্রায় প্রতিবাদ নাই, ন্যায়ের দাবি নাই, ধিক্কার তো নাই-ই, আছে শুধু সরকার ও সমাজের উদাসীনতার প্রতি আত্মসমর্পণ। নিয়তিকে মানিয়া, কোনও মতে প্রাণ লইয়া ঘরে ফিরিবার আশা। এখনও যদি সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য সুপরিকল্পিত ভাবে পরিবহণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করিতে পারে, তবে আরও অনেক মৃতদেহ বহন করিবার সময় আসিতেছে বলিয়া।