লকডাউনে দামোদর। ছবি: জয়ন্ত বিশ্বাস
‘করোনা তোমার ভয়ে বন্ধ হয়েছে সভ্যতা নামে দূষণ,/ তোমার জন্য বহুদিন পরে আকাশে হাসছে পূষণ।’ সম্প্রতি এই পঙ্ক্তিগুলিকে ঘিরে বিতর্ক ঘনীভূত হয়েছে। কিন্তু তলিয়ে দেখলে পঙ্ক্তিগুলির গুরুত্ব রয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, করোনাভাইরাসের কারণে গোটা বিশ্ব জুড়ে লকডাউন ঘোষণার পরে কিন্তু বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে পরিবেশের। চলতি বছরের গোড়ার দিকে চিনে লকডাউন ঘোষণার পরেই দেখা গিয়েছিল কারখানার বর্জ্য কমার ফলে সে দেশের নদ, নদীগুলিতে দূষণের পরিমাণ অনেকটাই কমেছিল। একই ভাবে ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশে লকডাউন ঘোষণার পরে সেই সব দেশগুলিতে কার্বন নিঃসরণ কমা ও প্রকৃতির নিজের ছন্দে ফেরার খবরও পরিবেশিত হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। সেই তালিকার বাইরে নয় আমাদের ভারতবর্ষও। পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ কমার পাশাপাশি, কমেছে নদী দূষণের ঘটনাও। তারই সঙ্গে কিছুটা হলেও প্রাণ সঞ্চারিত হয়েছে এই নদীকেন্দ্রিক বাস্তুতন্ত্রে।
আমাদের পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান জেলার প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে দামোদর নদ। দামোদর ও অজয়কে ঘিরেই এই এলাকার মানুষের দিনযাপন। কৃষি থেকে শুরু করে শিল্প— সবেতেই এই দুই জেলার মানুষ দামোদরের উপরে নির্ভরশীল। দামোদরের বুক থেকে তুলে আনা বালি যেমন এক দিকে, বহু মানুষের জীবনযাপনের রসদ জোগায়, তেমনই দামোদরের জলকে কেন্দ্র করে শিল্প এবং কৃষি— দুই চলে। পরিবেশবিদেরা বলছেন, গত কয়েক দশকে দামোদরের প্রধান সমস্যা হয়ে উঠেছিল ত্রিমুখী। প্রথমত, অবাধে বালি তোলা ও বালি খাদানে মাটি কাটার যন্ত্রের ব্যবহারের কারণে দামোদর ক্রমশ হয়ে উঠছিল বিধ্বংসী ও ভাঙনপ্রবণ। গত কয়েক দশকে যন্ত্র দিয়ে বালি তোলার কারণে ক্রমশ বদলে যেতে শুরু করেছিল দামোদরের গতিপথ। নদী তার নিজস্ব প্রবাহ ছেড়ে ক্রমশ ঢুকে পড়েছে লোকালয়ে। এর জেরে গলসি, দক্ষিণ দামোদরের মতো এলাকায় ক্রমশ কমছিল নদী অববাহিকা ও লোকালয়ের মধ্যেকার দূরত্ব। ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছিল বিঘার পর বিঘা কৃষিজমি।
দামোদরের অন্য দু’টি সমস্যা ছিল— সারা বছর ঠিকমতো জল না থাকা এবং নদীর জলের দূষণ। নদীর জলে শিল্পজাত রাসায়নিক মেশা নিয়ে বারবার আপত্তি তুলেছিলেন অনেকে। কিন্তু পরিবেশবিদদের আবেদন নিবেদন সত্ত্বেও হুঁশ ফেরেনি। একই ভাবে সারা বছর নদীতে জল না থাকায় দামোদর অববাহিকার কৃষকেরা অতিমাত্রায় ভৌম জলস্তরের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিলেন। ফলে দক্ষিণ দামোদর এলাকায় দেখা দিচ্ছে ভৌমজলের সঙ্কটও। এই পরিস্থিতে কিছুটা হলেও নদীর জল দূষণ কমানো থেকে শুরু করে নদীর চারপাশের বাস্তুতন্ত্রের চাপ কমানো— সবেতেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে লকডাউন।
দামোদর তীরবর্তী এলাকার মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বৈশাখের রাতে এখন হিমেল হাওয়ার আনাগোনা। বেড়েছে জলজ প্রাণীর যাতায়াতও। দামোদর তীরবর্তী এলাকার গাছপালায় বেড়েছে পাখিদের কলতান। তারই সঙ্গে সঙ্গে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে নদী তীরবর্তী জঙ্গলের বাস্তুতন্ত্রে। নদীতে ফিরে এসেছে ঝিনুক, শামুকের মতো প্রাণীরা। পরিবেশবিদেরা জানাচ্ছেন, নদীর জলে ও তার তীরবর্তী এলাকায় দেখা মিলছে নানা ধরনের সাপেরও। গত কয়েক দশকে নদীর ধারে বাঁধের গর্ত থেকে শিয়ালের দলের উঁকি মারার দৃশ্য কার্যত ভুলতে বসেছিলেন সাধারণ মানুষ। দক্ষিণ দামোদরের এলাকার বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, শিয়ালের দল নদীর চড় থেকে উঁকি দিতে শুরু করেছে লোকালয়েও। একই ছবি চোখে পড়ছে দামোদরের বড়শুল, মাধবডিহি, সালুন, গৈতানপুরের মতো এলাকাতেও। গৈতানপুরের বাসিন্দা, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক স্বপন মাঝি বলেন, ‘‘সন্ধ্যা নামলেই শিয়ালের দল বাড়ির আশেপাশে চলে আসছে। নদীর পাড়ে গেলে বালির চরে তাদের দেখা মিলছে। গত কয়েক দিনে নদীর চরে বহু জলজ উদ্ভিদ জন্মেছে।’’ জেলেরাও জানান, জালে ভালই মাছ আসছে। এমনিতেই গ্রীষ্মকালে চিংড়ির দেখা মেলে দামোদরের জলে। কিন্তু গত কয়েক দিনে চিংড়ি মাছের পরিমাণ অনেকটাই বেড়েছে বলে জানান তাঁরা। বেড়েছে অন্য মাছেরও সংখ্যাও।
সারা বছর বালি তোলা, নদীর সরে আসা নিয়ে আতঙ্কে দিন কাটাতে হয় এমন মানুষের জীবনচিত্রেও কিছুটা নিশ্চয়তার আভাস দামোদরের স্থিতাবস্থা ফিরে আসায়। ভেদিয়া, সাগরপুতুল, মাঝখাড়া গ্রামের অজয়ের পাড়ের বাসিন্দারা জানান, ভরা বর্ষায় নদীর জল বাড়লে সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সরকারি নির্দেশিকায় বালি কাটা বন্ধ থাকত। তবে তারই মধ্যে চোরাগোপ্তা বালি কাটার ঘটনা ঘটত। কিন্তু এখন বালি কাটা বন্ধ হতে নদীতে মাছ ও অন্য জীবেরা স্বচ্ছন্দে বিচরণ করতে পারছে। আগে যে নৌকা বালি নিয়ে ফিরত এখন তাতে থাকছে নানা স্বাদের মাছ।
এ বিষয়ে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিকেশন অফিসার তথা পরিবেশ গবেষক সন্তু ঘোষ জানান, পরিবেশের দু’টি ধর্ম আছে। একটি হল, ‘রেজিস্ট্যান্স’ বা বাধা দেওয়া, অপরটি হল ‘রেজিলিয়েন্স’ বা পরিবেশের নিজের স্বরূপে ফিরে আসার ক্ষমতা। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের অত্যাচার ও দূষণ একটা নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করলে তবেই প্রকৃতি নিজের পুরনো রূপে ফিরতে পারে না।’’ কিন্তু এই সময়ে বাড়তি দূষণ কমায় সে নিজের ধর্মে ফিরতে শুরু করেছে। তাঁর কথায়, ‘‘কয়েক দিনের এই লকডাউন প্রমাণ করেছে, একটু সচেতন হলে ও একটু দায়িত্বশীলতা দেখাতে পারলেই পরিবেশ তার পুরনো রূপে ফিরতে পারে। তাতে বাঁচবে মানুষ, বাঁচবে জীববৈচিত্রও।’’ বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের শিক্ষক অপূর্ব রতন ঘোষের মতে, ‘‘নদী হচ্ছে মাছের প্রজনন বৃদ্ধির অন্যতম জায়গা। নদীর স্রোতের সঙ্গে মাছের প্রজনন অনেকটাই নির্ভর করে। নদীর বুক থেকে বালি তোলা বা বড় বড় নৌকা চলার মতো ঘটনা ঘটলে মাছের ডিম নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। নৌকা থেকে নিঃসৃত ডিজেল বা আওয়াজ থেকে মাছেরা তাদের ডিম এবং শুক্রাণু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেয়। ফলে তাদের প্রজনন ঠিকঠাক হয় না। এ ছাড়াও জলে যদি দ্রবীভূত পদার্থ বেশি হয় সে ক্ষেত্রে ওই পদার্থগুলি মাছের ডিমের উপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে ডিম নষ্ট করে দেয়। লকডাউনে এই সমস্যাগুলি না থাকার কারণে নদীতে মাছের দেখা মিলছে। যদি নদীর বুকে অত্যাচার কমানো যায় তা হলে নদীগর্ভে এ রকম অনেক মাছ আবার দেখা যাবে।’’ কিন্তু প্রশ্ন, গৃহবন্দি মানুষ কি এর তাৎপর্য বুঝবে?