প্রথমে রাহুল গাঁধী, এ বার কমল নাথ। কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার, বিশেষত প্রধানমন্ত্রী মোদী বিষয়ে একটি গুরুতর অভিযোগ তুলিয়াছেন দুই জনই। বলিয়াছেন, মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্তও মোদী সরকার করোনার অপেক্ষা অনেক বেশি উদ্বিগ্ন ও ব্যতিব্যস্ত ছিল মধ্যপ্রদেশের ‘সরকার ফেলা সরকার গড়া’র খেলা খেলিতে। অভিযোগটি ফেলনা নহে। করোনা সঙ্কটে ভারতের ভাগ্যে ঠিক কী আছে, তাহা পরবর্তী কালে বোঝা যাইবে। কিন্তু এই কথাটি বুঝিতে অসুবিধা নাই যে, করোনা সঙ্কটের স্বরূপ বুঝিতে কেন্দ্রীয় সরকার তখন অহেতুক বিলম্ব করিয়াছিল, অন্যান্য রাজনৈতিক হিসাবপত্র কষিতে ব্যস্ত ছিল। যে সময়ে লাগাম কড়া ভাবে চাপিয়া ধরা দরকার ছিল, সেই সময়ে নেতাদের প্রশ্রয়ে দলের নেতারা করোনা নামক বিপদ লইয়া হাসাহাসি করিতেছিলেন। বাস্তবিক, তেইশ মার্চ দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণার ঠিক এক সপ্তাহ আগেও সংসদে এই বিষয়ে বিজেপি নেতাদের বিশেষ মাথাব্যথা দেখা যায় নাই, দিনে দশ মিনিটের বেশি ইহা লইয়া আলোচনা হয় নাই। দেশবাসীকে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখিবার লাগাতার উপদেশদান সত্ত্বেও রাজধানীতে লোকসভা অধিবেশন বন্ধ হয় নাই। অন্তত ২০ জন বিজেপি সাংসদ ১৮ মার্চ সংসদীয় বৈঠকে বসিয়াছিলেন, যাহার জের হিসাবে দুষ্যন্ত সিংহ ও বসুন্ধরা রাজেকে তাহার পরই কোয়রান্টিনে চলিয়া যাইতে হয়।
প্রসঙ্গত, এই সময়ে কিন্তু দেশে বহু স্থানেই বৈঠক, সভা, অনুষ্ঠান ইত্যাদি বাতিল করিবার দৃষ্টান্ত স্থাপিত হইতেছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তখনও সমস্যাটিকে গ্রাহ্যের মধ্যে আনে নাই— তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়ান প্রমুখের দাবি সত্ত্বেও। দুর্ভাগ্যজনক। যে সময়ে লকডাউনের আগাম প্রস্তুতি লওয়া যাইত, ভিনরাজ্যে কর্মরত শ্রমিকদের বাড়ি ফিরাইবার বন্দোবস্ত করা যাইত, দরিদ্র দুঃস্থ জনসাধারণের কাছে খাদ্যদ্রব্য পৌঁছাইবার উপায় ভাবা যাইত, জাতীয় নেতাদের চোখে সে দিনও মধ্যপ্রদেশই ছিল প্রধান ‘লড়াই’। এই অমার্জনীয় অমনোযোগ কোনও দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন সরকারের নিকট হইতে আশা করা যায় না।
আরও পড়ুন: এই আমাদের দুর্ভাগা দেশ
বিজেপির তৎকালীন মূল আকর্ষণকেন্দ্র মধ্যপ্রদেশে অবশ্যই চলিতেছিল কুনাট্য। বিধানসভায় বিধায়করা ‘কোথায় করোনা কিসের করোনা’ বলিয়া পদত্যাগরত মুখ্যমন্ত্রী কমল নাথের প্রতি ব্যঙ্গাত্মক উক্তি ছুড়িয়া দিতেছিলেন। ১৬ মার্চ কমল নাথ সরিয়া যাইবার পর শিবরাজ সিংহ চৌহান যখন ক্ষমতারূঢ় হইলেন, প্রথম মুহূর্ত হইতেই তিনি নিজেকে করোনা-আবর্তের মধ্যে নিক্ষিপ্ত দেখিলেন। সেই আবর্ত এমনই সজোর যে তিনি নিজের মন্ত্রিসভাও তৈরি করিয়া উঠিতে পারিলেন না। এখনও পর্যন্ত মধ্যপ্রদেশ করোনা-যুদ্ধ লড়িতেছে কেবল মুখ্যমন্ত্রীর একক উদ্যোগেই, না আছে সেখানে কোনও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, না স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এখনও কেন মন্ত্রীদের মনোনয়ন করা যায় নাই, বুঝিতে কষ্ট হয় না। কেবল করোনার ভয়াবহতা নহে, ক্ষমতা-কোন্দলের তাড়নাও তাহার অন্যতম কারণ। উচ্চাভিলাষী বিজেপি নেতাদের সহিত ক্ষমতার পাঞ্জা লড়িতেছেন বিগত কংগ্রেস মন্ত্রিসভার দলত্যাগী সদস্যরা, যাঁহারা বিজেপিকে সরকার-দানের প্রত্যুপহার হিসাবে বিশেষ পদের প্রত্যাশী। এই প্যান্ডোরার বাক্সের সামনে স্বভাবতই অসহায় হইয়া পড়িয়াছেন নূতন মুখ্যমন্ত্রী। ক্ষমতার খেলা সর্বদাই বিপজ্জনক। তবে করোনা-মৃত্যুহারে দেশের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে থাকা মধ্যপ্রদেশ যে ভাবে এই বার সেই বিপদের ভয়াল বাস্তব দেখিতেছে, ততখানিও সাধারণত প্রত্যক্ষগোচর হয় না। দেশব্যাপী স্কুল-কলেজ, ব্যবসা-বাণিজ্য, শপিং মল ইত্যাদি বন্ধ করিবার সহিত এত গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজ্যের সরকার পাল্টাইবার পালাটিকেও কিছু স্থগিত রাখা যাইতে পারিত। কে বলিতে পারে, তাহাতে হয়তো মহামারি-পীড়িত মানুষের কিছু সুবিধা হইত।
আরও পড়ুন: স্বাভাবিক হও বাংলা, এই গোমড়াপনা মানায় না তোমাকে