নববর্ষ সমাগত। অথচ চৈত্র সেল-এর জমজমাট বাজার বসে নাই। হাতিবাগান হইতে গড়িয়াহাট— কলিকাতার রাস্তা জনহীন, অধিকাংশ বিপণির ঝাঁপ বন্ধ। রাজ্যের অন্য সব প্রান্তেও চিত্রটি অবিকল এক। বিশ্বজোড়া অতিমারি আসিতে যে সময় ক্রেতার ভিড়ে রাজপথ উপচাইয়া পড়িবার কথা, সেই সময়ই লকডাউনের সূচনা হইয়াছে। রোগভয়ে এবং সরকারি নির্দেশে নাগরিক গৃহবন্দি। নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দোকান ব্যতীত অন্য দোকান বন্ধ। রোগসংক্রমণ হ্রাস এবং দৈনন্দিন খাবারের সংস্থান করাই এখন প্রধানতম চিন্তা। শাড়ি-বিছানার চাদর-বালিশের খোলের ক্রয়-বিক্রয় লইয়া চিন্তা করিবে কে? সুতরাং, বৈশাখী ছাড়ের বাজার শুনশান।
প্রাক্-বৈশাখ এই ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে এক নিখাদ বাঙালিয়ানা জড়িত। শুধু আবেগের অর্থে নহে, অর্থনীতির মাপকাঠিতেও। বহু গৃহস্থ তাঁহাদের সংসারের নানাবিধ প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করিয়া থাকেন এই সময়টিতেই— কারণ, প্রচলিত রীতি অনুসারে, চৈত্র সেলেই যাবতীয় পণ্য মেলে সর্বাপেক্ষা সস্তায়। অন্তত, মানুষের বিশ্বাস সেই রকমই। এই প্রসঙ্গে স্মরণ করাইয়া দেওয়া যাইতে পারে, আধুনিক মল-সংস্কৃতির বিপণনেও ‘সেল’ বস্তুটির মাহাত্ম্য অমোঘ— সংবাদপত্রে পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন দেখিয়া মধ্যবিত্ত মলে দৌড়ায় ছাড়ের সুবিধাটুকুর নিঃশেষ দখল লইতে। বঙ্গীয় সংস্কৃতির মাহাত্ম্যে কোনও বিজ্ঞাপন ব্যতিরেকেই চৈত্র সেলের ছাড়ের কথা সকলে জানেন। এই সময়টাতে কেনাবেচার পরিমাণ বাড়ে— মধ্যবিত্তের ঘরে সস্তায় বিছানার চাদর আসে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীও বৎসরের লাভের বড় অংশ ঘরে তুলিয়া লন। এবং, সেই সাপ্লাই চেন-এর সহিত জড়িত প্রত্যেকেরই আয় বাড়ে। অর্থাৎ, বঙ্গের ক্ষুদ্র অর্থনীতিতে চৈত্র সেল একটি বড় ঘটনা। কোভিড-১৯’এর ধাক্কায় এই বার সেই বাজারটি স্তব্ধ থাকিল।
করোনাভাইরাস অতিমারির প্রকোপে অর্থনীতির কী ক্ষতি হইতেছে, তাহা ইতিমধ্যেই বহু-আলোচিত। সেই ক্ষতির চরিত্রটি ঠিক কী রকম, চৈত্র সেলের এই আখ্যানটি তাহার সম্যক উদাহরণ। গোটা ভারতেই সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত মানুষের সংখ্যা অনুপাতে সামান্য— পশ্চিমবঙ্গে তাহা আরও কম, কারণ এই রাজ্যে বৃহৎ শিল্প নাই। চৈত্র সেলের ন্যায় অসংগঠিত বাণিজ্য মার খাইলে রাজ্যের অধিকাংশ মানুষের উপর তাহার প্রত্যক্ষ আর্থিক প্রভাব পড়িবে। বর্তমানে বাজার বন্ধ থাকায় ব্যবসা মার খাওয়া প্রথম দফার ক্ষতি। তাহার ফলে বহু মানুষের আয় কমিবে, ক্রয়ক্ষমতাও কমিবে। ফলে, কাল না হউক পরশুর পরের দিন বাজার খুলিলেও প্রথমত তাঁহাদের যথেষ্ট পণ্য কিনিবার সামর্থ্য থাকিবে না; এবং দ্বিতীয়ত, যেটুকু সামর্থ্য থাকিবে, ভবিষ্যতের ভয়ে মানুষ সেই টাকাও খরচ করিতে ইতস্তত করিবেন। অর্থাৎ, বাজারে চাহিদা তলানিতেই থাকিবে। এই চাহিদার অভাব হইতেই মন্দার জন্ম। ব্রিটেনের ন্যায় বেশ কিছু দেশে স্বনিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য সাময়িক ভাবে আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা হইয়াছে। ভারতেও তাহা প্রয়োজন— কিন্তু সেই আশা ক্ষীণ। বঙ্গবাসী, অতএব, একটি দুঃস্বপ্ন লইয়াই নূতন বৎসরে প্রবেশ করিতেছে। চৈত্র সেলের বন্ধ বা শূন্য বাজার পূজার পূর্বে ছন্দ ফিরিয়া পাইবে, আপাতত সেই প্রার্থনাটুকুই ভরসা।