এমন এক আতঙ্ক গোটা পৃথিবীতে আজ রাজত্ব করছে যে, স্বাভাবিক যুক্তি-বুদ্ধি কাজ না-করা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সকলে মিলে বুদ্ধিভ্রষ্ট হলে এই সঙ্কট থেকে পরিত্রাণের বদলে আরও গভীর হয়ে উঠতে পারে সঙ্কট; করোনার গ্রাস থেকে মানব সভ্যতা মুক্ত হয়ে ওঠার পরেও, গভীর ক্ষতচিহ্ন রেখে যেতে পারে তা।
দিল্লির নিজামুদ্দিনের তবলিঘি জামাতের জমায়েতের ঘটনাটি শুধু আমাদের দেশেরই নয়, সারা দক্ষিণ এশিয়ার করোনা পরিস্থিতিকেই রীতিমতো ঘোরালো করে তুলতে চলেছে। এই জমায়েতে অংশ-নেওয়া অনেকেরই করোনা টেস্ট ইতিমধ্যেই পজিটিভ ধরা পড়েছে। মারাও গিয়েছেন কেউ কেউ। এঁরা আমাদের দেশের এবং বিদেশের যে-সমস্ত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মেলামেশা করেছেন, তাদের মধ্যেও একটা বিপুল অংশ যে করোনা-আক্রান্ত হবেন, তার সম্ভাবনা প্রবল।
এই ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় সামনে এসে গিয়েছে মুসলিম-বিদ্বেষ। ভারতে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় একটি ধর্মের মানুষদেরই করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ করে তোলার জন্য দায়ী করতে শুরু করা হয়ে গিয়েছে। এমনকি অনেকেই এর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন ‘করোনা জিহাদ’-এর কথা।
নিজামুদ্দিনের তবলিঘি জামাতের জমায়েতটি একটি সঠিক জমায়েত ছিল? এক কথায় উত্তর হচ্ছে, ছিল না। মরকজ নিজামুদ্দিনের পক্ষে থেকে একটি বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, জমায়েতটি যখন সংঘটিত হয়, তখনও প্রধানমন্ত্রী দেশব্যাপী লকডাউনের কথা বলেননি। এটি সত্য। এও সত্য যে, দেশব্যাপী লকডাউন শুরু হওয়ার অনেক আগেই দিল্লি সরকার দিল্লিতে যে কোনও ধরনের বড় জমায়েত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনামা হয়তো ছিল না, কিন্তু দিল্লি সরকারের নির্দেশ ছিল। যার জেরে আইপিএল পিছিয়ে দেওয়া হয়। কাজেই নিজামুদ্দিনের যুক্তি ধোপে টিঁকবে না। দিল্লি সরকারের পক্ষ থেকে তাই এই মসজিদটির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে।
পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে ওঠার পরেও নিজামুদ্দিনে থেকে গিয়েছিলেন অনেক পুণ্যার্থী। এটিও নিয়ম লঙ্ঘন তো বটেই। বলা হচ্ছে যে, লকডাউন শুরু হওয়ার পরে ট্রেন না-চলায় অনেকেই ফিরতে পারেননি, তাই তাঁদের ওই মসজিদে আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়েছিল তবলিঘি জামাত। ঘটনা হল, ১৩ মার্চই দিল্লি সরকারের ২০০ জনের বেশি মানুষের একত্রে থাকা যাবে না, জমায়েত করা যাবে না— এই নির্দেশনামাটি প্রকাশ পেয়েছিল। ঠিক যে, দেশের সরকার নিরন্ন, বিপন্ন মানুষদের বাড়ি ফেরানোর জন্য যা যা পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল তা নিতে পারেনি বা নেয়নি। তাই গজিয়ে উঠেছে বাড়ি ফেরানোর সিন্ডিকেট। তাই পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছেন হাজার হাজার অন্নহীন, আশ্রয়হীন দিনমজুর। কিন্তু, নিজামুদ্দিনের মসজিদের ভিতরে ১৩ মার্চ থেকেই, দিল্লি সরকারের নিয়ম ভেঙে, যাঁদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল, গোটা দেশে লকডাউন শুরু হওয়ার আনেক আগেই তাঁদের সরিয়ে ফেলা যেত। আর প্রথম কথাটি হল এই যে, ওই ধর্মীয় সম্মেলনটির আয়োজনই ছিল দিল্লি সরকারের নির্দেশের বিরোধী।
কেউ কেউ বলছেন, এই জমায়েতটির পরেও বেশ কয়েকটি হিন্দু মন্দিরে জমায়েত হয়েছে। মধ্যপ্রদেশে শিবরাজ সিং চৌহান এক বড় জমায়েতে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন ২২ মার্চ। এগুলি নিশ্চয়ই গর্হিত কাজ হয়েছে। কেউ বলতেই পারেন, আইনের চোখে এই দু’ধরনের কাজকে একাসনে বসানো ঠিক হবে না— কেননা, হিন্দু মন্দিরগুলি সেই রাজ্যের নিয়ম লঙ্ঘন করেছে কি না, সেটি বিচার্য। আর চৌহানও কোনও ‘বেআইনি’ কাজ করেননি। যদিও অবশ্যই বলা যেতে পারে, বেআইনি কাজ না-করলেও, চৌহান অনৈতিক কাজ করেছেন। তাঁর উচিত ছিল নমো নমো করে শপথগ্রহণ পর্বটি শেষ করা।
কিন্তু তবলিঘি জামাতের জমায়েতটি অন্যায় জমায়েত ছিল বলেই দেশের সব ক’টি মসজিদের ওপর আমরা ঘৃণা বর্ষণ করব? বলব যে, একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষেরাই দক্ষিণ এশিয়ায় করোনা ছড়াচ্ছেন? আমরা কি ভুলে যাব যে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও একাধিক মসজিদে জমায়েত নিষিদ্ধ হয়েছে? নমাজ পড়া হচ্ছে বাড়ি থেকেই? মনের কোণে সুপ্ত থাকা মুসলিম-বিদ্বেষকে প্রকাশ্যে আনার বা এই ঘটনাটি নিয়ে রাজনীতি করার এই কি সময়? যাঁরা ভুল করছেন, তাঁদের ভুলগুলো আমরা নিশ্চয়ই ধরিয়ে দেব, সোশ্যাল মিডিয়ায় বা অন্যত্র নিশ্চয়ই বলব। কিন্তু এমন ভাবে বলব যাতে সেই বলা বিদ্বেষ বা ঘৃণা না-ছড়ায়।
যাঁরা যাঁরা তবলিঘি জামাতের ওই সমাবেশে ছিলেন, তাঁদের চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে। এটিই এই মুহূর্তের সবচেয়ে জরুরি কাজ। শঙ্খ ঘোষের একটি বিখ্যাত কবিতার পঙ্ক্তিকে ঈষৎ পালটে নিয়ে অনেকেই বলছেন যে, এই সময়টা কাছে কাছে নয়, দূরে দূরে বেঁধে বেঁধে থাকার সময়। ঘৃণা আর বিদ্বেষের কথা এখন অন্তত থাক।