ছবি রয়টার্স।
অতিমারি পাল্টাইয়া দিল বিবর্তনসঞ্জাত একটি ধর্মকে— মানুষের যুথবদ্ধ জীবনযাপনের ধর্ম। সমাজবিচ্ছিন্নতাই এখন বাঁচিবার পথ। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। এই পর্ব যন্ত্রণার, গভীর অবসাদের। ইহার অভিঘাত প্রবীণদের উপর অধিকতর। অবসাদ একাকিত্বের কারণে— সামান্য মেলামেশার পথটুকুও রুদ্ধ হইয়া সম্পূর্ণ পরনির্ভরশীল এক জীবন কাটাইবার বাধ্যবাধকতায়। অবসাদ মৃত্যুভয় হইতেও। বিশ্বব্যাপী করোনা-মৃত্যুহারে স্পষ্ট, কো-মর্বিডিটির কারণে প্রবীণরাই অধিকতর হারে এই অতিমারির শিকার। এই সত্যকে মানিয়া লইয়াই অতিমারির চরম অবস্থায় স্পেন-ইতালির ন্যায় উন্নততর চিকিৎসা-পরিকাঠামোযুক্ত দেশেও বহু ক্ষেত্রে প্রবীণদের হাসপাতাল-শয্যা অবধি পৌঁছাইবার সুযোগ দেওয়া হয় নাই। নবীন প্রজন্মকে চিকিৎসার সুযোগ করিয়া দিতে স্পেনে হাসপাতালগুলিকে নির্দিষ্ট বয়ঃসীমার ঊর্ধ্বের নাগরিকদের ভর্তি না করাইবার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছিল স্থানীয় প্রশাসনের তরফে। ফলে, রোগাক্রান্ত অসংখ্য বয়স্ক মানুষ কার্যত বিনা চিকিৎসায়, নিঃসঙ্গ মৃত্যুবরণ করিয়াছেন।
ইহা অমানবিক, সভ্যতার নিদারুণ তমসাচ্ছন্ন দিক। ভারতের সৌভাগ্য, তাহার অবস্থা ইউরোপের ন্যায় শোচনীয় হয় নাই। মাত্র কয়েক ঘণ্টার নোটিসে জনজীবন স্তব্ধ করিয়া দেওয়া হইলেও কলিকাতার ন্যায় শহরের বিভিন্ন আবাসনে নবীন প্রজন্ম স্বেচ্ছায় বয়স্ক বাসিন্দাদের প্রয়োজনের প্রতি খেয়াল রাখিবার দায়িত্ব লইয়াছিল। কোথাও পাড়ার ছেলেরা উদ্যোগ করিয়া নিঃসঙ্গ প্রবীণদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী, ঔষধের জোগান দিয়াছে। ফোনে কুশলসংবাদ লইয়াছে। কন্টেনমেন্ট জ়োনে প্রশাসনও কাঙ্ক্ষিত ভূমিকাটি পালন করিয়াছে। রান্না করা খাবার, আনাজ, ঔষধ গৃহস্থের বাড়ি নিয়মিত পৌঁছাইয়া দেওয়া হইয়াছে।
কিন্তু ঘোর অন্ধকারে ইহা শুধুমাত্র কিছু রুপালি রেখাই। ভারতের বিশালসংখ্যক প্রবীণদের সঙ্কটকালে ইহা কোনও স্থায়ী সমাধান নহে। প্রবীণরা যে সাহায্য পাইয়াছেন, তাহা ব্যক্তি সহনাগরিকদের সদিচ্ছার কল্যাণে। শুধুমাত্র তাহার ভরসায় সমাজ চলিতে পারে না। পাকাপোক্ত ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়। সমীক্ষায় প্রকাশ, লকডাউন-অন্তে আর্থিক কর্মকাণ্ড শুরু হইবার সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ততা বাড়িতেছে নবীনদের। প্রবীণদের পুনরায় গ্রাস করিতেছে একাকিত্বের যন্ত্রণা। সুতরাং, সমাধান অন্য পথে আসা প্রয়োজন, এবং তাহা ভাবিতে হইবে করোনা-পরবর্তী নূতন পৃথিবীর কথা মাথায় রাখিয়াই। যে পৃথিবী অস্থির এবং ক্রমান্বয়ে পরিবর্তনশীল, যেখানে চাকরি হইতে রসদ সংগ্রহ সকলই অনিশ্চিত। এই নূতন পৃথিবীতে বয়স্করা সমাজ ও অর্থনীতির মূল প্রবাহ হইতে বিচ্ছিন্ন বলিয়া অনেকাংশে উপেক্ষিত। স্পেনের প্রশাসন কোভিড-১৯’এর চিকিৎসার ক্ষেত্রে বয়স্কদের অবহেলা করিবার যে সিদ্ধান্ত লইয়াছিল, চাহিদা-জোগানের সমীকরণ মানিয়া তাহা হয়তো জরুরি ছিল, কিন্তু সিদ্ধান্তটি বয়স্ক মানুষের সামাজিক দাম বিষয়ে ভয়ানক বিপজ্জনক বার্তা দেয়। প্রশাসনের প্রথম কাজ ইহা নিশ্চিত করা, যেন সমাজ বয়স্কদের অবান্তর ভাবিতে আরম্ভ না করে। নাগরিক উদ্যোগগুলিকে স্থায়ীতর করিয়া তুলিবার জন্যও প্রশাসনিক সাহায্য ও সমর্থন প্রয়োজন। সর্বোপরি, সমাজের কর্তব্য হইল শুভবোধের দীপশিখাটিকে অনির্বাণ রাখিতে পারা।