এই ক’দিনে বয়সটা যেন দ্রুতগতিতে বাড়ছে। শুধু আমারই নয়, সবারই! আমার ন’বছরের ছেলেটাও যেন মনে মনে মানিয়ে নিচ্ছে। স্কুল তো বন্ধই হয়ে গিয়েছে। বাড়িতে বসে থেকে ছটফটে ছেলেটা বিরক্ত হচ্ছিল। তবে, এখন আর জেদ করছে না। ‘লকডাউন’ শব্দটার অর্থ বারকয়েক জানতে চেয়েছে শুধু।
আমাদের প্রজন্ম তো বটেই, অশীতিপর অনেকে, যাঁরা ১৯৬২ সালের চিন যুদ্ধ দেখেছেন, তাঁরাও এমন স্মৃতি মনে করতে পারছেন না। আসলে, যুদ্ধটা শুধু যে অসম, তাই নয়, বরং এক অজানা-অচেনা শত্রুর সঙ্গে। এই মহামারীর প্রকোপে গ্রস্ত এই মুহূর্তে ১৯০টি দেশ। প্রাণ গিয়েছে ১৬ হাজার মানুষের। আক্রান্ত প্রায় চার লক্ষ। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। এক এক করে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও শক্তিধর দেশগুলো সামাজিক ও মানসিক ভাবে ভাঙতে শুরু করছে। চিন প্রথম ধাক্কা সামলে নিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, ব্রিটেন, ইরান, আমেরিকায় মৃত্যুমিছিল। গোটা বিশ্ব ভয়ে কাঁটা। ইতালির প্রধানমন্ত্রীর অসহায় ভাষণ, কানাডার প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রীর অসুস্থতার ভিডিও, ইরানের মৃত্যুমিছিল আমাদের চোখে জল আনছে। দিনদিন কপালের ভাঁজ চওড়া হচ্ছে বিশ্ববাসীর।
এখন প্রশ্ন, ১৩০ কোটির দেশ ভারতের কী হবে? যে দেশ-জাতি ধর্ম-বর্ণ ভেদে বহুবিভক্ত, তারা কী ভাবে করোনাভাইরাস নামক অতিমারীর মোকাবিলা করবে? প্রথমেই আমাদের দেখা দরকার দু’টো বিষয়। জনসংখ্যা আর জনঘনত্ব। যা চিন কিংবা ইউরোপীয় দেশগুলির তুলনায় অনেক অনেক বেশি। এবং ভারতের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো। ইতালি যেখানে দু’নম্বরে, আমরা সেখানে ১৪৪ নম্বরে। তবে, অনেক প্রেক্ষাপট এখানে কাজ করে। আমাদের দেশে যত ভেন্টিলেশন যন্ত্র আর পরীক্ষার সরঞ্জাম আছে এই ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য, তা দিয়ে আমরা করোনাভাইরাসের সঙ্গে সম্মুখসমরে পেরে উঠব না। কারণ, এটা অসম লড়াই। অতএব, পন্থা গরিলা যুদ্ধ। অর্থাৎ, লকডাউন, যা সদ্য করা গিয়েছে। সুন্দর শব্দবন্ধ— সামাজিক দুরত্ব। কেন যে বারবার বলা হচ্ছে দুরত্ব বজায় রাখতে, তা যদি কারও বুঝতে অসুবিধে হয়, তার জন্য বলে রাখা জরুরি যে, ঘরে থাকুন, পরিবারকে ঘরে রাখুন, পাড়াপ্রতিবেশীকে ঘরে রাখুন, তা হলেই আপনি ও আপনার পরিবার তথা গোটা সমাজ বাঁচবে। পুতিন নাকি তাঁর দেশেদু’টি বিকল্প দিয়েছেন— হয় ১৫ দিন গৃহবন্দি অথবা ৬ মাস জেল।
ভারতে এই ধরনের সংক্রমণে ভয় যেমন হয়, ভরসাও তেমন হয়। নানা সমস্যা বা বিপদ যা করতে পারেনি, করোনাভাইরাসের আতঙ্ক তা অনেকটাই করে দেখাচ্ছে। আমরা এক হচ্ছি ভয়ে, অন্তত আপাতত এটাই ভরসা। লকডাউন অবস্থায় চিহ্নিত করতে হবে রোগীদের আর তাঁদের চিকিৎসা করতে হবে আলাদা রেখে। ফলে, সংখ্যাটা নিয়ন্ত্রিত থাকবে এবং পরিষেবা দেওয়া সম্ভব হবে।
দু’টো খারাপ ছবি, যা থেকে আমাদের সাবধান হওয়া দরকার। জনতা কার্ফুর দিনে বা লকডাউনের সময়ও অনেক জায়গায় লোককে দল বেঁধে পথে বেরিয়ে পড়তে দেখা গিয়েছে এবং যাচ্ছে। এই নির্বুদ্ধিতা মারাত্মক ঘটাতে পারে। কারণ, মুল বিষয়টাই লঙ্ঘিত হচ্ছে। সন্তানের হাত ধরে পাড়ায় ঘোরা, মোড়ে আড্ডা বা মাঠে খেলার সময় পরেও পাওয়া যাবে! ইতালি যে সামান্য দেরি করেছিল, তার একাংশও যদি আমরা করি, পরিণতি ভয়ঙ্কর হবে! হতাশাজনক চিত্র সামনে আসছে। পুলিশকে বলপ্রয়োগ করতে হচ্ছে। কেন? সভ্য দেশে এটা একেবারেই কাম্য নয়। এ আত্মহত্যারই নামান্তর! আমরা সময় পাব না, যদি না এখনও সতর্ক হই। বহু জায়গায় দেখা যাচ্ছে, লোকজন দল বেঁধে বাইরে ঘুরছেন পিকনিকের মেজাজে! আমরা গৃহবন্দি না হলে কমিউনিটি স্প্রেডিং শুরু হয়ে যেতে পারে!
এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষকেরা কর্তব্যে অবিচল থেকে পথচলতি জনগণকে ঘরে থাকতে অনুনয় করছেন। অনেকে চেষ্টা করছেন সরকারি তহমিলে অনুদান দিতে মানুষকে উৎসাহিত করতে বা স্থানীয় ভাবে স্যানিটাইজার বানাতে। এই জায়গাগুলো আশা-ভরসার! প্রশাসন সদর্থক ভূমিকা নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। নবীন প্রজন্ম এগিয়ে আসছে সচেতনতা তৈরি করতে। আর চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা যে ভাবে সমাজের সেবা করছেন, তা অনুকরণীয়! করোনাভাইরাস প্রতিরোধের একমাত্র পথ জনসংযোগ বিচ্ছিন্ন করা। লকডাউন তাই অবশ্যপালনীয়। আমার ন’বছরের বাচ্চা এটা বুঝে গিয়েছে। নিজেকে আবদ্ধ করে নিয়েছে এক ঘরে। তা হলে আমরা সবাই পারব না কেন!
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, ভারত যে ভাবে প্লেগ, স্মল পক্স বা পোলিও দূরীকরণে সক্ষম হয়েছে অতীতে, সে ভাবেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর লড়াইয়েও ভারতের জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সতর্ক থাকাই একমাত্র পথ। আমরা নিশ্চয়ই পারব, এই বিপদকে কাটিয়ে উঠতে। কিন্তু প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো ভুলে গেলে চলবে না। কারণ, একটা ছোট ভুলও নিদারুণ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে!
(লেখক কোচবিহার জেলার নিবন্ধক। মতামত ব্যক্তিগত)