এই বর্ণবিদ্বেষের কবল থেকে বাঁচার প্রতিষেধক কি কখনও মিলবে না?
আলব্যের কামুর দিগ্বিজয়ী উপন্যাস ‘দ্য প্লেগ’ (১৯৪৭)-এ মুখ্য চরিত্র ডাক্তার রিয়ু-র মাধ্যমে উঠে এসেছিল লেখকের বিস্ময়— ওরান শহরে প্লেগ ছড়াচ্ছে, তাতে মানুষের এত বিহ্বলতা কেন? কামু লিখেছেন, সবাই জানেন, মহামারি ঘটতেই পারে, তার পরেও আকাশ ফুঁড়ে অকস্মাৎ দুর্দৈব আমাদের মাথায় লাফিয়ে পড়লে কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না। কোভিড-১৯ অভিজ্ঞতাও একই কথা বলে। প্রাত্যহিকের ঝিকিমিকি আর কোলাহলে আমরা এতটাই বুঁদ হয়ে থাকি যে, ঘটমানের বাইরে মনই দিতে পারি না।
এবং এই আকস্মিক কম্পনের অভিঘাত সামাল দিতেই সমাজ ঢাল করে তোলে শ্রেণি-বিভাজন, প্রাতিষ্ঠানিকতা ও জাতপাতের ক্ষমতার খেলাকে। গঠনপ্রক্রিয়ায় জৈব-বৈজ্ঞানিক হওয়া সত্ত্বেও মহামারি তখন সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অর্থনীতির চ্যুতিরেখাগুলি বরাবর আগুন ধরিয়ে দেয়। মহামারি পর্বের প্রকৃত ঘাতক তো অণুজীব, এতটাই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র তারা যে আমরা চোখে দেখতে পাই না। অথচ মহামারির ধাক্কায় উৎকণ্ঠা-উদ্বেগে আমাদের মন বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মহামারির আগের সময়ের সমাজ সম্পর্কগুলির বদান্যতায়, ‘ভিতরকার’ সমস্ত আলোড়নই বেরিয়ে আসতে চায় বাইরের সমাজে। শুরু হয় ‘অপর’-এর অনুসন্ধান, যাকে ভাইরাসের নাম ও কাজের সঙ্গে জুড়ে বেশ করে দাগিয়ে দেওয়া যাবে। জীববিদ্যা তখন এ ভাবেই তার সামাজিক রূপ প্রকাশ করে।
কিন্তু এই ‘অপর’-এর প্রয়োজন হয় কেন? এই প্রশ্নের অনেকগুলো ‘সম্ভাব্য’ উত্তর দেওয়া যায়। প্রথমত, ভাইরাসের সঙ্গে যোগ করার মতো বলির পাঁঠা খুঁজে পেলে একটা জুতসই অজুহাত খাড়া করা যায়। ঔপনিবেশিক ভারতে কলেরা মহামারি বিষয়ক লেখায় ইতিহাসবিদ ডেভিড আর্নল্ড বলেছিলেন যে, এই কারণেই কোনও না কোনও মানবগোষ্ঠীকে বলির পাঁঠা করাটা অপরিহার্য: ‘ভাইরাসকে জনবসতির গণ্ডি থেকে বিতাড়নের প্রতীক রূপে তথাকথিত নিচু জাতির লোক, আদিম জনজাতির মহিলা, দেহোপজীবিনীকে গ্রাম থেকে তাড়ানো হত।’ দ্বিতীয়ত, অপরায়ণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ‘অপর’-এর আচার-আচরণ বিশ্লেষণ করে, তারাই যে রোগের বাহক তা বুঝিয়ে দেওয়ার মতো একটা ‘জ্ঞানভাণ্ড’ তৈরি করা যায়, যদিও সেই জ্ঞানের সত্যতার কোনও দায় থাকে না।। তৃতীয়ত, এতে সেই ‘অপর’-এর উপরেই দোষটা গছিয়ে দেওয়ার কাজটা হয়ে যায়। দেখানো হয়, ওদের অভ্যাস বা কাজকর্ম ‘অস্বাভাবিক’, কাজেই ওদের সঙ্গে রোগটার সংযোগ আছে। স্বাভাবিক রাস্তায় বাঁচলে ভাইরাস আর অসুখ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। চতুর্থত, ভাইরাস মহামারি যেহেতু আমাদের জীবনযাপনটাকেই টলিয়ে দেয়, ‘নিউ নর্মাল’ জীবনে নিজেদের খাপ খাওয়াতে প্রয়োজন হয়ে পড়ে মহামারি-পূর্ব সামাজিক বিন্যাসের এই চ্যুতিরেখাগুলোর উপর ভরসা রাখা।
আরও পড়ুন: যাঁদের ঘর ছাড়তে হয়েছিল
সুতরাং, সেই পথেই চলেছি সকলে আপাতত। অতিমারি চলাকালীন, ‘উহান’ বা ‘চিন’ ভাইরাসের মতো শব্দগুচ্ছের প্রয়োগই এ কথা প্রমাণ করে। অথচ ভৌগোলিক অঞ্চল অনুযায়ী নোভেল ভাইরাসের নাম দিলে কেবল যে হু (ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজ়েশন)-র নির্দেশিকা লঙ্ঘন করা হয়, তা-ই নয়, উক্ত ভৌগোলিক এলাকার ব্যক্তিবিশেষ তথা জনসমষ্টিকে লজ্জা ও কলঙ্কের ভাগীও হতে হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সম্প্রদায়গুলি এই মুহূর্তে গোটা বিশ্ব জুড়েই জাতিবিদ্বেষের শিকার। মনে করা যেতে পারে, তবলিগি জামাত সম্পর্কিত সাম্প্রদায়িক মন্তব্যগুলির আগেই ভারতে মোঙ্গোলয়েড গড়নের (ফেনোটাইপ) মানুষেরা ভয়-হিংসার শিকার হয়েছিলেন। দার্জিলিঙের পাহাড়ি অঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বের রাজ্য থেকে আসা মানুষ জাতিগত অবমাননার মুখে পড়েছিলেন।
আরও পড়ুন: পুলিশবাহিনীর চোখে আজও কৃষ্ণাঙ্গ মানেই সন্দেহভাজন
একটি জরুরি কথা। পরিযাণ কেন্দ্র (আগমন-ভিত্তিক) রূপে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটা গুরুত্ব আছে। ভারতের নানা অংশের, এমনকি বহির্বিশ্ব থেকেও মানুষ এখানে ভাগ্যানুসন্ধানে আসেন। ইদানীং অবশ্য এই পরিযায়ী-জীবনে বড় পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। ১৯৯১ থেকে ২০১১ সময়কালের পরিযাণের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাচ্ছি, যাঁরা এই অঞ্চলে আসছেন, আর যাঁরা অঞ্চল ছেড়ে বাইরে যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে সংখ্যার তফাতটা কমে আসছে। উত্তর-পূর্ব থেকে বহির্মুখী জনতার ঢলটা এখন বিশাল। এই কালপর্বে প্রায় ২৩ লক্ষ বাসিন্দা এলাকা ছেড়ে গিয়েছেন। একটা বড় অংশ ভারতের শহরগুলিতে এসে যুক্ত হয়েছেন অফিস-কাছারির কাজে (হোয়াইট কলার জব)। মুখ্যত পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র, দিল্লি এবং কর্নাটকে।
ঘর থেকে বেরিয়ে এই সব নতুন জায়গায় এসে পরিযায়ীরা এক নতুন সামাজিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। নতুন পরিসরে থাকার জন্য তাঁদের অনেক কিছু মেনে নিতে হয়, অনেক কিছুর সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াতে হয়। এই খাপ খাওয়ানোর বিষয়টা কিন্তু কেবল তাঁদের নিজেদের উপর নির্ভর করে না, স্থানীয় মানুষের উপরেও নির্ভর করে। আর তাই প্রক্রিয়াটা বেশ জটিল হয়ে দাঁড়ায়। যাঁরা আসছেন, জাতি ও সংস্কৃতির দিক থেকে তাঁরা এতটাই আলাদা যে ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক ও জীবনপ্রণালীর বিচারে সমাজের বাকিদের সঙ্গে নিজেদের মেলাতে গিয়ে তাঁরা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। তাঁদের মোঙ্গোলয়েড ফেনোটাইপের জন্য অনেকেই অস্বস্তিকর চাহনিতে তাঁদের দিকে তাকান। তাঁদের গতে বাঁধা ‘স্টিরিয়োটাইপ’-এর ছকে ফেলে খাটো করে দেখা হয়। পরিচয়ের আগে থেকেই এঁদের ও এঁদের সমাজ নিয়ে নানা ভুল অনুমান আর সংস্কার ছড়িয়ে দেওয়া হয়। গড়ে ওঠে অদৃশ্য প্রাচীর। সেই প্রাচীর চোখে দেখা যায় না, কিন্তু তার কাঁটাতার ভীষণ ভাবে বিঁধে যায় অনুভবে। এর শিকড়টি গাঁথা থাকে অন্তরে লালিত জাতিবিদ্বেষী ধারণায়। তাকে উপড়ে ফেলা অতি কঠিন।
বিশ্ব জুড়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় জনগোষ্ঠীর দিকে এমন কাদা ছোড়া হয়েই চলেছে। ভারত ভূখণ্ডে তাঁদেরই যাতনার চিহ্ন বহন করে চলেছেন মোঙ্গোলয়েড বৈশিষ্ট্যের অধিকারীরা। আগে শহরের পথেঘাটে জাতিবিদ্বেষী মন্তব্য হিসেবে শুনতে হত ‘চিঙ্কি’, ‘মোমো’। আর এখন ‘করোনা’ বলে ডেকে গায়ের ঝাল মেটানো হয়। ব্যাডমিন্টন তারকা জ্বালা গাট্টার বাবা অন্ধ্রপ্রদেশের, মা চিনা। তাঁকে তাই ‘হাফ করোনা’ বলে ট্রোল করা হচ্ছে। জম্মুর বাজারে এক লাদাখি ছেলেকে তাচ্ছিল্য করে বলা হয়েছে, ‘চল হট, আপলোগো কি ওয়জাহ্ সে করোনা আয়া হ্যায়।’ কলকাতায় উচ্চশিক্ষারত দার্জিলিঙের ছাত্রদলকে ভরা বাসে ‘করোনাভাইরাস’ বলে ডাকা হয়েছে। জায়গা থাকলেও সহযাত্রীরা তাঁদের পাশে বসেননি, ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। দিল্লিতে মণিপুরি মেয়েকে ‘করোনা’ বলে ডেকে একটা লোক তাঁর গায়ে থুতু ছিটিয়ে দিয়েছেন। বেঙ্গালুরুতে প্রতিবেশীরা মাঝরাতে উত্তর-পূর্বের লোকেদের ফ্ল্যাটে চড়াও হয়ে তাঁদের জোর করে কমপ্লেক্সের বাইরে বার করে দিয়েছেন। যুক্তি দিয়েছেন, ভাইরাসের হাত থেকে এ ভাবেই এলাকাকে বাঁচাতে হবে। এ কাজকে মহান দেশসেবা বলে তাঁরা তুলে ধরেছেন। মহীশূরের দোকানে অত্যাবশ্যক পণ্য কিনতে এসেছিলেন নাগাল্যান্ডের এক দল পড়ুয়া। আধার কার্ড দেখিয়ে ভারতীয়ত্বের প্রমাণ দেওয়া সত্ত্বেও তাঁদের দোকানে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কারণ, তাঁদের চিনাদের মতো দেখতে! একই রকম ভাবে, আমদাবাদের বিপিও-তে কর্মরতা নাগাল্যান্ডের ছয় তরুণীকে জবরদস্তি করোনা পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। কারণ, ‘ভুল করে’ লোকে তাঁদের চিনা ভেবেছিল।
এ সবই ঘটেছে সাম্প্রতিক অতিমারি চলাকালীন। কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে এদের দেখা যাবে না, বরং এগুলো এক সঙ্গে যে কোলাজ তৈরি করে তাতে মূল ভূখণ্ডের মূলস্রোতের সমাজের একটা বড় অংশের মনের চিন্তাধারার জীর্ণতাই ফুটে ওঠে। গুরুগ্রামে চাকরি করেন, মিজোরাম থেকে আসা এমন এক পরিযায়ী সখেদে বলেছেন, ‘কোভিড-১৯ মূল ভূখণ্ডের ভারতীয় সমাজের কুৎসিত চেহারাটা প্রকাশ করে দিয়েছে... আগে আমরা ছিলাম ‘চিঙ্কি’, ‘নেপালি’ বা ‘চিনে’। এখন আমরা ‘করোনা’। আমরা যে ‘ভারতীয়’, সে কথা ওঁদেরকে বলে বলে বোঝাতে হবে কেন? কেন ভারতীয় হওয়ার প্রমাণ দিতে হবে আমাদের? কই এক জন বাঙালি, পঞ্জাবি বা মালয়ালিকে তো সেই প্রমাণ দিতে হয় না? আমাদের মতো তাঁদেরও কিন্তু যথেষ্ট আলাদা দেখতে। ওঁরা কি বোঝেন না যে ভারতীয়দের দেহের নানা রকম গড়ন (ফেনোটাইপ) হয়? এটাই তো জাতিবিদ্বেষ।’ পাঠকের নিশ্চয়ই মনে পড়ছে, মণিপুরি বক্সার মেরি কমের বায়োপিকে পর্যন্ত যে বলিউড অভিনেত্রীর প্রয়োজন হয়েছিল, তাঁর মুখটি এই এক ছাঁচে ঢালা ভারতীয়ত্বেরই আদর্শ নমুনা।
কোভিড-১৯’এর টিকার জন্য বিশ্ব জুড়ে আকুল প্রার্থনা চলছে। আর এই বর্ণবিদ্বেষের কবল থেকে বাঁচার প্রতিষেধক কি কখনও মিলবে না?
ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা