চিনে কোভিড-১৯ দেখা দেওয়ার বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই বিশ্বায়নের রথের চাকা থমকে গিয়েছিল। ২০০৮-এর বিশ্ব আর্থিক সঙ্কটের পরে বিশ্ব অর্থব্যবস্থার ভঙ্গুরতা ধরা পড়েছিল, যখন বেকারত্ব ও কমতে থাকা বৃদ্ধির হারের সঙ্গে বিশ্বে বাড়ছিল আর্থিক বৈষম্য। পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত বৃদ্ধির যে চক্র সদা চলমান বলে অর্থনীতিবিদরা আমাদের শিখিয়েছেন, তা আর কাজ করছিল না।
যেটুকু ছিল, কোভিড-১৯-এর প্রকোপে তা-ও ধ্বস্ত। যে কোনও অর্থব্যবস্থার বৃদ্ধির জন্য পুঁজি ও শ্রমের গতিময়তা অত্যন্ত প্রয়োজন। বাজারে পুঁজি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাবে, কারখানা খোলা থাকবে, পরিবহণ ব্যবস্থা কাজ করবে, শ্রমিকরা কাজে আসবেন, পণ্য উৎপাদন এবং সরবরাহ করবেন, তবেই অর্থব্যবস্থা সচল থাকবে, বৃদ্ধি হবে। কিন্তু কোভিড-১৯ অতিমারির অভিঘাতে পুঁজি নিথর হয়ে কলকারখানায় পড়ে আছে, শ্রমিকরা কাজে যেতে পারছেন না, সরবরাহ বন্ধ। অতএব, অর্থব্যবস্থায় সঙ্কট আসা স্বাভাবিক।
যে কোনও অর্থনৈতিক সঙ্কটকে আমরা দুই ভাবে দেখতে পারি— মোট চাহিদার সঙ্কট অথবা জোগানের সঙ্কট। মানুষের হাতে টাকা নেই, তাই তাঁরা পণ্য কিনতে পারছেন না। এহেন পরিস্থিতিতে পণ্যের উৎপাদন কমবে। একে আমরা চাহিদার সঙ্কট বলতে পারি। আবার যত পণ্য বাজারে প্রয়োজন, তত উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। একে আমরা জোগানের সঙ্কট বলতে পারি। নোট বাতিলের সময় বা ২০০৮-এর বিশ্ব মন্দার ক্ষেত্রে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার দরুণ আর্থিক বৃদ্ধির হার নিম্নগামী হয়। একে আমরা চাহিদার সঙ্কট বলতে পারি। কিন্তু এখন কোভিড-১৯’এর প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী তথা আমাদের দেশে লকডাউনের ফলে চাহিদা ও জোগান দু’দিক থেকেই অর্থব্যবস্থায় সঙ্কট এসেছে। সব কলকারখানা বন্ধ, কোনও উৎপাদন হচ্ছে না। এমনকি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জোগানেও ঘাটতি দেখা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। জোগানের সঙ্কটও অবশ্যম্ভাবী। আবার অভিবাসী শ্রমিক-সহ সমস্ত মজুর, বিশেষ করে যাঁরা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন, তাঁদের উপার্জন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাঁরা ক্রয়ক্ষমতা হারিয়েছেন। ফলে ঘনীভূত হয়েছে চাহিদার সঙ্কটও। ২০০৮ সালের থেকেও গভীর সঙ্কট আসতে চলেছে।
বলতে পারেন, আমাদের দেশে লকডাউন তো মাত্র ২১ দিনের। এর পরে আবার অর্থব্যবস্থার চাকা চালু হবে, দেশের আর্থিক বৃদ্ধি আবারও লকডাউন শুরু হওয়ার সময়ের হারে পৌঁছতে বেশি সময় নেবে না। মুশকিল হল, অর্থনীতির ঘড়ি এক ধাক্কায় ঘুরিয়ে আগের জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। যেমন আজ যে অভিবাসী শ্রমিকেরা কাজের অভাবে গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন, লকডাউন উঠে গেলেই তাঁরা আবার শহরে ফিরে এসে একই রকম কাজ পাবেন, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। বা, যে কারখানা আজ ঝাঁপ ফেলতে বাধ্য হয়েছে তা কালই সচল হয়ে যাবে, এ কথা হলফ করে বলা যায় না। নোটবাতিলের ফলে ২০১৬ সালের নভেম্বর এবং ডিসেম্বর মাসের মধ্যে নোটের আকাল সর্বাধিক হলেও অর্থব্যবস্থার উপরে তার অভিঘাত বহু দিন রয়ে গিয়েছে। তাই লকডাউন উঠে গেলেই অর্থব্যবস্থা চাঙ্গা হবে না। লকডাউন হওয়ার আগেও অর্থব্যবস্থার অবস্থা বেশ খারাপ ছিল। লকডাউনের পরে তা আরও খারাপ হবে এবং ভারতে দেখা দেবে মন্দা। সেটা কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে তা আর্থিক নীতি এবং কোভিড-১৯’এর প্রকোপ কতখানি পড়বে তার উপরে নির্ভরশীল।
এখানেই অবধারিত ভাবে উঠবে সরকারের নীতির প্রশ্ন। গোটা দেশে লকডাউনের জন্য যে প্রস্তুতি দরকার তা সরকারের ছিল না। লকডাউনের পরে সরকার গরিব মানুষের জন্য একটি প্যাকেজ ঘোষণা করে যার মূল্য ১.৭ লক্ষ কোটি টাকা, যা আমাদের দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মাত্র ০.৮ শতাংশ। তুলনা টানার জন্য বলে রাখা দরকার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জিডিপি-র ১০ শতাংশ বরাদ্দ হয়েছে কোভিড-১৯ পরবর্তী আর্থিক সঙ্কটের মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে। সরকার-ঘোষিত আর্থিক প্যাকেজ অপ্রতুল। গরিব অভিবাসী শ্রমিকদের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছে যে সরকার ঘোষিত সুবিধাগুলি পাবেন বলে তাঁরা মনে করেন না। অন্য দিকে, প্যাকেজের বেশ কিছু ঘোষণা পূর্বনির্ধারিত, যেমন ১০০ দিনের কাজের মজুরি বৃদ্ধি বা কৃষকদের েব্যাঙ্কে ২০০০ টাকা প্রদান। আবার রেশনে গরিব মানুষের জন্য খাদ্যশস্যের বরাদ্দ দ্বিগুণ করতে সরকারকে কোনও বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে না। ইতিমধ্যেই সরকারি গুদামে মজুত আছে প্রায় ৭.৫ কোটি টন খাদ্যশস্য যা গরিব মানুষকে দেওয়া হবে। মাসে ১০০০ টাকা বা ৫০০ টাকা যাঁদের দেওয়া হবে, তাঁরা ওই টাকায় কী ভাবে সংসার চালাবেন?
তা হলে কী করণীয়? গোটা দেশ এক সঙ্গে বন্ধ করে দেওয়ার ন্যায্যতা নিয়েই প্রথমত প্রশ্ন রয়েছে। সরকার যথেষ্ট পরিমাণ কোভিড-১৯ পরীক্ষা করাচ্ছে না। এই পরীক্ষা পরিকল্পনা করে সারা দেশে করতে হবে, যাতে বোঝা যায় কোন রাজ্যে বা অঞ্চলে কোভিডের প্রকোপ বেশি, কোথায় কম। এক বার এই চিত্রটা পরিষ্কার হয়ে গেলে রাজ্য বা অঞ্চলভিত্তিক লকডাউনের কথা ভাবা যেতে পারে। আবার অভিবাসী শ্রমিকদের নথিভুক্ত করে তাঁদের স্বার্থে সরকারকে টাকা দিতে হবে। সমস্ত অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের বেতন যদি সুরক্ষিত না-ও করা যায়, মাসে তাদের ৫০০০ টাকা করে সরকারি অনুদান দেওয়া যেতে পারে। ছোট ব্যবসা ও বিশেষ কিছু ক্ষেত্র যেমন পর্যটন, পরিবহণে সরকারকে প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে।
সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, গণ সরবরাহ ব্যবস্থা, গরিব মানুষদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা ছাড়া বড় মহামারির মোকাবিলা আমরা করতে পারব না। তাই অবিলম্বে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবায় জিডিপি-র ৩ শতাংশ খরচ করতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। জেলায় জেলায় দক্ষ সরকারি হাসপাতাল গড়ে তুলতে হবে। গণ সরবরাহ ব্যবস্থা ও সামাজিক সুরক্ষাকে মজবুত করতে হবে। গরিব মানুষদের জীবনে কোভিড ছাড়াও অসংখ্য রোগ আছে যার প্রতিকার তাঁরা পান না, কারণ পর্যাপ্ত সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা নেই। সরকারি সাহায্য বাদে তারা দু’বেলা খাবার জোগাড় করতে পারেন না। মানুষের জন্য এই ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে আমরা পিছিয়েই থাকব।
এত টাকা কোথা থেকে আসবে? জিডিপি-র ৩ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে খরচ করতে হলে ২০১৯-২০ সালের হিসেবে লাগবে ৬ লক্ষ কোটি টাকা। কোভিডের প্রকোপে সরকার ইতিমধ্যেই খরচ করছে ১.৭ লক্ষ কোটি টাকা। ধরা যাক আমরা এই খরচ দ্বিগুণ করতে চাই এবং সরাসরি পণ্য সরবরাহে এবং মানুষের হাতে এই টাকা তুলে দিতে চাই। তা হলে সব মিলিয়ে খরচ হবে আনুমানিক ৯.৫ লক্ষ কোটি টাকা। ভারতের মোট সম্পদের পরিমাণ ১২.৬ লক্ষ কোটি ডলার (ক্রেডিট সুইসের হিসেব), যা ভারতীয় মুদ্রার হিসেবে ৮৮২ লক্ষ কোটি টাকা (১ ডলার = ৭০ টাকা ধরা হয়েছে)। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ অর্থাৎ ৬৬১ লক্ষ কোটি টাকা রয়েছে ধনীতম ১০ শতাংশ ব্যক্তির কাছে। এদের উপরে যদি ১.৫ শতাংশ সম্পদ কর বহাল করা হয়, তা হলে কাঙ্ক্ষিত অর্থ সহজেই পাওয়া যাবে। অর্থব্যবস্থা আবার চলতে শুরু করলে গরিব মানুষের হাতে টাকা তুলে দেওয়ার পরিমাণ কমে আসবে। তদুপরি, রাজ্য সরকারগুলিও বাড়তি খরচ করতে পারে। আগামী দিনে তাই এই করের পরিমাণ কমতেও পারে। দেশের ধনীতম ১০ শতাংশের সম্পদের উপর মাত্র ১.৫ শতাংশ করা বসালে ৯০ শতাংশ মানুষের সমস্যা কমবে।
অর্থনীতি বিভাগ, আইডিএসকে, কলকাতা