এক ভাইরাস আজ সমগ্র পৃথিবীতে মৃত্যুর ধ্বজা উড়াইয়া তাহার কৃষ্ণবর্ণ অশ্ব ছুটাইয়া বেড়াইতেছে, তাহাকে থামাইবার জন্য প্রয়োজন হাসপাতাল, পরীক্ষার সরঞ্জাম, ডাক্তারদের সুরক্ষার সরঞ্জাম, রোগীদের নিভৃতবাসের বন্দোবস্ত। গরিব মানুষদের নিকট নিত্যব্যবহার্য বস্তু ও খাদ্য বিতরণ প্রয়োজন। দিনমজুর ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের গ্রাসাচ্ছাদনের উপায় নির্ধারণ প্রয়োজন, দেশব্যাপী লকডাউনের পরিস্থিতিতে। এই প্রবল দুর্দশার মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন বিপুল অর্থের। সরকার কিছু ব্যবস্থা করিতেছে, বহু ধনী ও খ্যাত মানুষ অনেক টাকা দান করিতেছেন, তবু যথেষ্ট হইতেছে না। পঞ্চদশ বর্ষীয় এক ছাত্র প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে পত্র লিখিয়া অনুরোধ করিল, তিনি যেন ভারতের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে বাধ্য করেন (ধর্ম নির্বিশেষে), এই সঙ্কটকালে তাহাদের সম্পদের শতকরা ৮০% দান করিতে। দেহরাদূনের এই দশম শ্রেণির ছাত্রটির পিতামাতা উভয়েই চিকিৎসার সহিত যুক্ত। তাঁহারা প্রত্যহ হাসপাতালে যান, তাঁহাদের অভিজ্ঞতার কথা ছাত্রটি শুনিয়াছে। তাহার মনে হইয়াছে, লকডাউনের সময়সীমা আরও বৃদ্ধি পাইতে পারে। সে ক্ষেত্রে মানুষের দুর্দশা আরও বাড়িবে, খাদ্যের অভাব ঘটিবে। মানুষ না খাইয়া মরিলে, দেবতার প্রসন্ন হইবার কারণ নাই।
ছেলেটি লিখিয়াছে, এই সম্পদ ঈশ্বরের সম্পদ, ঈশ্বরের সন্তানদের দুর্দশা দূর করিবার নিমিত্ত এই অর্থ ব্যয় করিলে ঈশ্বর নিশ্চিত ভাবেই খুশি হইবেন। এবং তাহার পর এক অনবদ্য বাক্যে যোগ করিয়াছে, সেই ব্যবস্থা হইলে, সকলে মানবিকতায় অধিক বিশ্বাসী হইয়া উঠিবেন। সত্যই, ঈশ্বরে বিশ্বাস যদি মানুষের অন্তরে দেবত্বের বিকাশ না ঘটাইতে পারিল, তবে তাহা অনেকাংশেই অসার্থক। মুশকিল হইল, এই বিশ্বাস মূলত পাঠ্যগ্রন্থের ভাবসম্প্রসারণের অংশে সুলভ। বাস্তবে, ঈশ্বরের ধারণা মনুষ্যসমাজে অবতীর্ণ হইবার পর, বিশেষত বিবিধ ঈশ্বর বিবিধ সংগঠিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কুক্ষিগত হইবার পর, মানুষ ঈশ্বরের নামে সুকর্মের অপেক্ষা মন্দ করিয়াছে অধিক। কখনও ঈশ্বরে অবিশ্বাসীদের জীবন্ত দগ্ধ করা হইয়াছে, কখনও ঈশ্বরে বিশ্বাসীদের চূড়ান্ত শাস্তি দেওয়া হইয়াছে। কখনও অমুক ঈশ্বরে বিশ্বাসী গোষ্ঠী, তমুক ঈশ্বরে বিশ্বাসী গোষ্ঠীকে আক্রমণ করিয়া হত্যালীলা চালাইয়াছে, কখনও ফিরতি মার খাইয়াছে। ঈশ্বরের নামে শত অত্যচার সহস্র নিগ্রহ লোকে সোল্লাসে করিয়াছে, বহু ধর্ম-ক্ষমতাবান মানুষ রাজশক্তির সহিত মিলিয়া নিরীহ প্রজাদের অশেষ নিপীড়ন করিয়াছে। তাই বিপুল সম্পদের অধীশ্বর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি শত শত নিরন্ন মানুষের মুখে খাদ্য তুলিয়া দিতে ঈশ্বরের সম্পদ অকাতরে খরচ করিবে, ভাবা দুষ্কর। সাধারণত মানুষের নির্মিত ঈশ্বর মানুষকে নিষেধ করিতে শাসন করিতে ও নিগড়ে বাঁধিতে ভালবাসেন, মানুষকে দুঃখ হইতে ত্রাণ করিবার দিকে তাঁহার বিশেষ উৎসাহ লক্ষিত হয় নাই।
সত্য, ঈশ্বরবিশ্বাস বহু মানুষকে শান্তি ও দাহ-উপশম দান করিয়াছে। সত্য, বহু ঈশ্বরসেবী গোষ্ঠী মানুষকে সঙ্কটে সেবা করিতে সদা তৎপর। অনেক আস্তিক মনে করেন, মানুষ না থাকিলে ত্রিভুবনেশ্বরের প্রেম মিথ্যা হইত, ঈশ্বরের লীলার সাক্ষী থাকে একমাত্র মুগ্ধ ও কৃতজ্ঞ মানুষ, তাই ভগবানের ন্যায়ই গুরুত্বপূর্ণ হইল ভক্ত। অতএব ভক্তকে অভয় দান করিবার দায় দেবতারও কিছু কম নহে। কিন্তু শুষ্ক ও অনুভূতিহীন ধর্মকর্তাদের হস্তে পড়িয়া আজ দেবতার ভূমিকা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেবল নির্লজ্জ গ্রহীতার। ধর্ম যে কেবল কয়েকটি নির্দিষ্ট আচার পালন নহে, অমুক তিথিতে উপবাস ও তমুক লগ্নে সশব্দ আরতি ও ভজনা নহে, ধর্মের অর্থ যে ব্যাপকতর এবং তাহা অবধারিত ভাবে মানুষের— বিশেষত দরিদ্র হতভাগ্য উপেক্ষিত মানুষের— উন্নতিসাধনের ব্রতে উপনীত হইতে বাধ্য, তাহা এখন অনেকেই ভুলিয়া বসিয়াছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ছেলেটির প্রশ্ন অতীব গুরুত্বপূর্ণ। করোনাভাইরাস চলিয়া যাইলেও, প্রশ্নটি চলিয়া যাইবে না। এই দেশের বহু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে আর্থিক সম্পদের কূলকিনারা নাই। সেই সম্পদ কোন কাজে লাগে, আর কোন কাজে লাগা উচিত? মানুষ ঈশ্বরকে যে দক্ষিণা দিতেছে, সেই বিত্ত মানুষের উপকারের নিমিত্ত ব্যয় করিবার আইন করিলে, তাহা কি ধর্মবিরোধী, না সর্বোচ্চ ধর্মের অনুকূল? নগর পুড়িলে দেবালয় এড়ায় না। আজ অগ্নি ছড়াইতেছে, আর এই উত্তপ্ত প্রশ্নগুলি রহিয়াছে দ্রুত উত্তরের অপেক্ষায়।
যৎকিঞ্চিৎ
কলকাতা পুলিশ কোথাও ‘উই শ্যাল ওভারকাম’, কোথাও বিখ্যাত গানের সুরে করোনা-সচেতনতার কথা গাইছে। বাড়িবন্দি গায়কেরা করোনা নিয়ে নতুন গান তৈরি করছেন। ফেসবুকে করোনা-সংক্রান্ত কাব্য, রসিকতা, ছড়া, মাইকেল থেকে সুকুমারের প্যারডি উপচে পড়ছে। উপন্যাসও তৈরি হচ্ছে নির্ঘাত। করোনোত্তর পৃথিবীতে করোনা-শিল্প নিয়ে থিসিস হবে নিশ্চয়ই। এই প্লাবনে মন খারাপ শুধু সত্যজিৎ রায়ের। তাঁর শতবর্ষটা আইন করে এক বছর পিছিয়ে দেওয়া যায় না?