পুলিশ কমিশনার অনুজ শর্মা।
গত সপ্তাহে কলিকাতার পুলিশ কমিশনার অনুজ শর্মা কর্তৃক সকল থানা ও ট্র্যাফিক গার্ডের নিকট নির্দেশ পৌঁছাইয়াছে— কানুন অমান্য করিলে পুলিশেরও রেহাই মিলিবে না। যাহা বিশ্বের প্রায় সব সভ্য শহরে একেবারে স্বাভাবিক ঘটনা, কলিকাতায় নগরপালকে তাহা ফলাও করিয়া বলিতে হইতেছে— এই ঘটনাটিই বলিয়া দেয়, মহানগরের আইনরক্ষকরা আইন হইতে কতখানি দূরে সরিয়া গিয়াছেন। ট্র্যাফিক সার্জেন্ট সিগনাল ভাঙিয়া বাইক চালাইতেছেন, কিংবা ‘নো পার্কিং জ়োন’-এ গাড়ি রাখিতেছেন পুলিশ অফিসার, কলিকাতার রাস্তায় এমন উদাহরণ প্রাত্যহিক। পুলিশের উর্দি গায়ে চাপাইলে, অথবা গাড়িতে পুলিশ লেখা স্টিকার আটকাইলেই আর কোনও আইনের তোয়াক্কা করিতে হয় না, এই কথাটি পুলিশের সকল স্তরের কর্মীদের মনে গাঁথিয়া রহিয়াছে। বিশ্বাসটি ভিত্তিহীনও নহে। ট্র্যাফিক আইন ভাঙিয়া পুলিশকর্মীর জরিমানা হইতেছে, শহরের রাজপথে এ হেন দৃশ্য দেখিবার সৌভাগ্য কয় জনের হইয়াছে? ইহা নিঃসন্দেহে ক্ষমতার আস্ফালন। দীর্ঘ কাল ধরিয়া এই রূপ ক্ষমতা প্রদর্শন চলিবার ফলেই অস্বাভাবিক বেনিয়মগুলিই আজ স্বাভাবিক হইয়া উঠিয়াছে। সকলেই ধরিয়া লন, পুলিশ আইন ভাঙিবে ইহাতে আশ্চর্য কিছু নাই, কারণ উহারা নিয়মের ঊর্ধ্বে। নিজেদের ক্ষেত্রে পুলিশ নিয়ম মানে না বলিয়াই অন্যান্য ‘প্রভাবশালী’ বা তাঁহাদের ঘনিষ্ঠদেরও ছাড় দেয়, না কি প্রভাবশালীদের ছাড় দেওয়াই দস্তুর বলিয়া নিজেদেরও আইনের ঊর্ধ্বে রাখিতে অভ্যস্ত হইয়া পড়ে, সেই কূট তর্কে প্রবেশ না করিয়াও বলা বিধেয়, শহরের রাজপথে যাহা চলে, তাহাকে চলিতে দেওয়া যায় না।
নগরপালের সাম্প্রতিক ঘোষণায় পুলিশকর্মীদের অভ্যাস বদলাইবে? পুলিশের ভাবমূর্তি ফিরিবে? এই ঘোষণা আশার জন্ম দেয়। সমাজে যাঁহাদের আদর্শ হইয়া উদাহরণ স্থাপন করা উচিত, তাঁহারা দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার করিতেছেন দেখিলে ভরসা জাগে। কিন্তু সেই আশা নিতান্ত ক্ষীণ। সদিচ্ছার প্রমাণ পুলিশকেই পেশ করিতে হইবে। ইদানীং কলিকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজ-এ সুললিত গদ্যে আপন কাজকর্মের প্রচার করা হইতেছে। অপরাধী চিনাইয়া দেওয়া কিংবা সচেতনতা অভিযানেও উহাকে ব্যবহার করা হইতেছে। ট্র্যাফিক আইনভঙ্গকারী পুলিশকর্মীর সংবাদও সেই মাধ্যমে চোখে পড়িলে হয়তো মানুষ বিশ্বাস করিবে যে সত্যই পুলিশ বদলাইতেছে। নচেৎ, কর্তার সদিচ্ছা গঙ্গার হাওয়ায় উড়িয়া যাইতে বেশি সময় লাগিবে না।
প্রশ্ন হইল, পুলিশকর্মীদের মানসিকতার বদল না ঘটিলে কি এই পরিবর্তন আদৌ সম্ভব? শাস্তির ভয়ে নহে, সোশ্যাল মিডিয়ায় সম্মানহানির ভয়েও নহে— পুলিশকর্মীরা যত ক্ষণ না নিজেরা বিশ্বাস করিতেছেন যে আইন মানিয়া আদর্শ স্থাপন করা তাঁহাদের কর্তব্য, তত ক্ষণ অবধি কি কর্তার কোনও নির্দেশই ছবিটি বদলাইতে পারিবে? ধরা পড়িবার ভয়ে নহে, বরং তাঁহাদের দেখিয়া সাধারণ মানুষ নিয়ম মানিতে অনুপ্রাণিত হইতেছেন, এই বোধ হইতে পুলিশকর্মীদের ট্র্যাফিক নিয়ম মানিতে হইবে। এই বোধটি তৈরি করিবার দায়িত্ব কর্তাদের। এত দিনে তাঁহারা নিশ্চয় বুঝিয়াছেন, পুলিশ তত ক্ষণই কার্যকর, যত ক্ষণ অবধি সাধারণ মানুষের মনে তাহাদের প্রতি সমীহ থাকে। এবং, সেই সমীহ অর্জনের প্রকৃষ্টতম পন্থা আইনের প্রতি দৃশ্যত দায়বদ্ধ থাকা।