অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষণের দাবিটি ন্যায্যতার। বহু শতাব্দীর অন্যায়ের ইতিহাস মুছিবার ক্ষমতা কোনও রাষ্ট্রেরই নাই, কিন্তু সেই অন্যায় যাহাতে বন্ধ হয়, এবং তাহার প্রভাব যেন বর্তমানের উপর না পড়ে, তাহা নিশ্চিত করিতেই সংরক্ষণ ব্যবস্থা। কিন্তু, সেই যুক্তি ব্যবহারের জন্যও যথেষ্ট ভাবিতে হইবে। কিছু দিন পূর্বে ইউজিসি-র নূতন নিয়ম বাঁধিয়া স্থির করা হইয়াছিল, গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইবার প্রক্রিয়াটি দ্বিস্তরীয় হইবে। প্রথম স্তরে লিখিত পরীক্ষা, যাহাতে অন্তত ৫০ শতাংশ নম্বর পাইলে তবেই দ্বিতীয় স্তরে ইন্টারভিউয়ে ডাক পাওয়া যাইবে। ভর্তির সিদ্ধান্ত নির্ভর করিবে ইন্টারভিউয়ের উপর। প্রথমে সিদ্ধান্ত হইয়াছিল, তফসিলি জাতি, জনজাতি বা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত প্রার্থী— প্রত্যেকের জন্যই লিখিত পরীক্ষায় ‘কাট-অফ’ সমান থাকিবে। সিদ্ধান্তটিকে কেন্দ্র করিয়া খানিক বিতর্ক হয়, এবং সম্ভবত দলিত রাজনীতির নিকট লাগাতার নাজেহাল হওয়ার ফলেই কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত পাল্টায়। সংরক্ষিত শ্রেণির প্রার্থীদের জন্য ‘কাট-অফ’ দশ শতাংশ কমিল।
গবেষক স্তরে ‘কাট-অফ’ কমাইবার সিদ্ধান্তটির অন্যায্যতা প্রশ্নাতীত। অনগ্রসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষণ, বিশেষ সুবিধা নিশ্চিত ভাবেই প্রয়োজন, কিন্তু তাহা এমন উচ্চ স্তরে নহে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, এমনকি স্নাতক স্তরেও সংরক্ষণের মাধ্যমে যত বেশি সম্ভব অনগ্রসর শ্রেণির ছেলেমেয়েকে প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থায় অগ্রসর হইতে সাহায্য করা বিধেয়। তাহাদের শিক্ষার অগ্রগতির জন্য আর্থিক সাহায্য, বিশেষ প্রশিক্ষণের ন্যায় যাহা প্রয়োজন, সকল ব্যবস্থাই করিতে হইবে। এমনকি, উচ্চতর স্তরে শিক্ষার জন্যও প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রস্তুতিতে অনগ্রসর শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু, পিএইচ ডি-র ন্যায় সর্বোচ্চ স্তরের শিক্ষার ক্ষেত্রে অনগ্রসর শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্য যোগ্যতামান কমাইয়া রাখিবার অর্থ, শিক্ষার গুণগত মানের সহিত সমঝোতা করা। বস্তুত, ‘কাট-অফ’ কমাইবার সিদ্ধান্তটি বিপজ্জনকতর। উচ্চতম শিক্ষার ক্ষেত্রেও যদি অনগ্রসর শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের কিছু বিশেষ সুবিধা দিতেই হয়, তবে তাহা তাঁহাদের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক সংরক্ষণের মাধ্যমে হউক, যোগ্যতামান কমাইবার মাধ্যমে নহে। নীতিটি হউক এই রকম: সমমানের প্রার্থীদের মধ্যে অনগ্রসর শ্রেণির প্রার্থীদের দাবিকে প্রাধান্য দেওয়া হইবে। কিন্তু, মানের সমতা নিশ্চিত করিতেই হইবে।
অনগ্রসর শ্রেণির জন্য শিক্ষায় সংরক্ষণের দাবির মূলে আছে ন্যায্যতার দর্শন— সকলের জন্য সমান সুযোগের ব্যবস্থা করা। সেই দর্শনের দুইটি স্তর। এক, কোনও বৈষম্য না রাখা, অর্থাৎ সমান যোগ্যতার প্রার্থীদের মধ্যে ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ বা অন্য কোনও প্রভেদ বিচার না করা; দুই, ঐতিহাসিক বঞ্চনার কারণে যাঁহারা পিছাইয়া আছেন, তাঁহাদের কিছু বাড়তি সুবিধা দেওয়া, যাহাতে তাঁহারা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ পান। দ্বিতীয় দাবিটি পূরণ করিতে গিয়া যাহাতে দেশের বৃহত্তর ক্ষতি না হয়, তাহাও নিশ্চিত করিতে হইবে। উচ্চতম শিক্ষার ক্ষেত্রে অনগ্রসর শ্রেণির ছাত্রদের সুযোগের যোগ্য করিয়া তোলাই ন্যায্য। আর্থিক বা অন্য কোনও কারণে তাঁহারা যোগ্যতা সত্ত্বেও বাদ না পড়েন, তাহা নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব।