ভোট পেতে সাম্প্রদায়িকতার কানাগলিতেই ঢুকতে হবে? কেন?

ফাঁদ পাতলেই পা দেব?

সবাই জানেন, পশ্চিমবঙ্গে রাম-রাজনীতির গর্বিত প্রকাশ ঘটছিল কয়েক বছর ধরেই। বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকে। বছর দু’এক তা বেশ বেড়ে যায়

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৮ ০০:৫৫
Share:

জবাবি?: ‘সম্প্রীতির জন্য’ সমবেত কলকাতার কিছু নাগরিক। প্রেস ক্লাব, ৪ এপ্রিল। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

মুখ্যমন্ত্রী ঠিকই বলেছিলেন, ‘‘রাম কা নাম বদনাম না করো।’’ কিন্তু তা হল কই? রামনবমী নিয়ে এ বারের উন্মত্ততা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকলের কাছে যুগপৎ আতঙ্ক ও বেদনার কারণ হয়ে রইল। সেই সঙ্গেই প্রমাণ হয়ে গেল, এই রাজ্যেও বিষবৃক্ষের ফল ফলতে শুরু করেছে। অভিযোগ উঠছে, সেই গাছের গোড়ায় তৃণমূলও জল ঢালছে। কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

Advertisement

কিন্তু এটাও ভুললে চলবে না, এই দায় সিপিএম এবং কংগ্রেসের মতো দলগুলিরও কিছু কম নয়। ক্ষমতায় না থাকলেও তারা যদি নিজেদের সক্রিয় রাজনৈতিক অস্তিত্ব এবং জনভিত্তি কিছুটা হলেও বজায় রাখতে পারত, তা হলে বিজেপির উত্থান কিছুতেই এত দ্রুত হত না। নিজেদের অপদার্থতায় সেই জমি তারা বিজেপিকে ‘উপহার’ দিয়েছে।

সবাই জানেন, পশ্চিমবঙ্গে রাম-রাজনীতির গর্বিত প্রকাশ ঘটছিল কয়েক বছর ধরেই। বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকে। বছর দু’এক তা বেশ বেড়ে যায়। গত বছর রাম-বাহিনী তৃণমূলকেও টেনে রাস্তায় নামায়। এ বার তো রামের দখলদারি নিয়ে রীতিমতো টক্কর!

Advertisement

যদিও রাম আদতে বাংলায় সর্বজনীন ভাবে পূজ্য ‘দেবতা’ নন। উত্তর ভারতে, হিন্দি বলয়ে রাম-পূজন সুপ্রাচীন। তার ব্যাপকতাও প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এই রাজ্যে তা নয়। তিনি এখানে ‘আদর্শ পুরুষ’ রূপে মান্য ঠিকই, কিন্তু ‘হিন্দুত্ব’-এর প্রতীকরূপে গণ্য হননি। তাই এ রাজ্যে রামনবমীর এমন ঘটাও দেখা যেত না। এখানকার রাম প্রধানত হিন্দিভাষী হিন্দু এলাকায় কেন্দ্রীভূত ছিলেন। রাম মন্দির, হনুমান মন্দিরগুলিও গড়ে উঠেছে সেই সব জায়গায়।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বঙ্গ-বিজেপির কুশলতায় অবশ্য এই রাজ্যেও রামচন্দ্রের পরিসর বেড়ে গিয়েছে। ধর্ম এবং রাজনীতি, উভয় ক্ষেত্রেই এখন তাঁর অবস্থান। এতটাই যে, গত বারের রামনবমীর অভিজ্ঞতায় অনেকে প্রমাদ গনেছিলেন। অনেকেই বলেছিলেন, উত্তর ভারতের রাম-রাজনীতি এই রাজ্যে প্রশ্রয় পেয়ে গেলে তাতে হিন্দুত্ববাদীদের তাৎক্ষণিক ‘লাভ’ হতে পারে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সম্প্রীতির ঐতিহ্যে কালি লাগলে সেই ক্ষতি হবে দীর্ঘস্থায়ী এবং তার ফল ভোগ করতে হবে সকলকে। সেই আশঙ্কা অনেকাংশে সত্যি হল।

বিজেপি তার ‘কথা’ রেখেছে। দিলীপ ঘোষ ও তাঁর লোকজনরা ঘোষণা করেছিলেন, রামের জন্মোৎসব পালনের মিছিল হবে সশস্ত্র। বলেছিলেন, তাঁদের অভিযান কেউ রুখতে পারবে না। পারল না। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী সশস্ত্র মিছিল করতে দেওয়া হবে না বলে জানানোর পরেও জেলায় জেলায় মিছিলে অস্ত্রের ঝলকানি বন্ধ করা গেল না। রামভক্তির আতিশয্যে ছোট-ছোট ছেলেদের পর্যন্ত অস্ত্র হাতে কসরত করতে দেখা গেল।

পুলিশ কার্যত দাঁড়িয়ে দেখল। কোথাও কোথাও আক্রান্ত হল। রামভক্তদের একটি গেরুয়া মিছিলে কর্তব্যরত পুলিশ কর্মী খাকি উর্দি পরে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিয়ে নাচতে নাচতে চলেছেন, তেমন ছবিও ছড়িয়ে পড়ল সোশ্যাল মিডিয়ায়। আসানসোলে দাঙ্গা, পুরুলিয়ায়, কাঁকিনাড়ায় সংঘর্ষ, রাজ্যে সব মিলিয়ে অন্তত ছ’জনের মৃত্যু ইত্যাদি তো আরও গুরুতর ব্যাপার।

কিন্তু প্রশ্ন হল, এই পরিস্থিতি তৈরি হল কেন? প্রশাসনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এটা প্রধানত পুলিশের ব্যর্থতা। নির্দিষ্ট ভাবে আই বি-র। কারণ কোথায় কী পরিস্থিতি তৈরি হতে যাচ্ছে, তার আগাম খবর তাদের তরফে ছিল না। মুখ্যমন্ত্রীও সেই ব্যর্থতার দিকে আঙুল তুলেছেন।

তবে কোনও সংঘর্ষই তো একতরফা হতে পারে না। মূলে থাকে প্রতিপক্ষকে দমনের তাড়না, প্রতিরোধ, শক্তি প্রদর্শন, ক্ষমতার আস্ফালন— কিছু না কিছু। রাম-লড়াইতেও সেটাই হয়েছে। বিজেপির রামকে ফাঁকা ময়দান ছেড়ে দিতে তৃণমূলের রাম রাজি হয়নি। রাজনীতির পাশা খেলায় এটা কি তৃণমূলের ভুল চাল? বিষয়টি ভাবার।

ঠিক-ভুল নিয়ে আলোচনা করার আগে এটা মানতে হবে যে, তৃণমূলের এ ছাড়া কোনও পথ ছিল না। বিজেপি তাদের রাম-প্যাঁচে ফেলে দিয়েছে। এত দিন ধরে শাসক তৃণমূলের সমালোচনা করতে গিয়ে বিজেপির মতো দল তাদের ‘সংখ্যালঘুদের তোষণকারী’ বলে চিহ্নিত করেছে। আজও করে। শাসক দলের নেতানেত্রীরাও অকপটে বলে থাকেন, তাঁরা সচেতন ভাবেই সংখ্যালঘুদের পাশে আছেন এবং থাকবেন। আসলে ত্রিশ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট নিজের ঘরে তোলার ক্ষেত্রে এটা তৃণমূল কার্যকর কৌশল বলে মনে করে।

কিন্তু এই ত্রিশ শতাংশ বৃত্তের বাইরে যে বিপুলায়তন ভোট ব্যাঙ্ক রয়েছে, তাকে হিসাবের বাইরে রাখা অসম্ভব। তৃণমূল এখন সেটা বেশি করে বুঝছে। সিপিএম এবং কংগ্রেস যত দিন চাঙ্গা ছিল, তত দিন তৃণমূল-বিরোধী ভোট ভাঙার সুবিধা ছিল বেশি। এখন দুই বিরোধীর ক্ষয়ে বিজেপির স্বাস্থ্যবৃদ্ধি হয়েছে। ফলে লড়াইটা প্রধানত দ্বিমুখী। তাই ভোটের ভাগটাও জরুরি।

একটা টাটকা উদাহরণ দিয়ে বলি। সম্প্রতি নোয়াপাড়া বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন হয়ে গেল। বিজেপিকে হারিয়ে তৃণমূল জিতেছে প্রায় ৬৭ হাজার ভোটে। আপাতদৃষ্টিতে তাদের পক্ষে খুব আশাব্যঞ্জক ফল। কিন্তু পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, বিজেপি যে ৩৮ হাজার ভোট পেয়েছে, তার প্রায় ৩০ হাজারই এসেছে তথাকথিত বঙ্গভাষী এলাকা থেকে। যার অর্থ, বাকি দুই বিরোধীর ভোট গ্রাস করে বিজেপি সাধারণ বাঙালি এলাকায় ভাল ভাবে পা রেখেছে। তাকে এখন আর মূলত অ-বঙ্গভাষী ভোটে সীমাবদ্ধ রাখা যাচ্ছে না। বঙ্গ রাজনীতিতে এই ভোট-বিন্যাস অর্থবহ। আর এটা ঘটছে বলেই রাম, হনুমান সংস্কৃতিও বাঙালিদের ঘরে ক্রমশ জায়গা পেয়ে যাচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে শুধু সংখ্যালঘু ভোট পেলেই তো চলবে না। অ-সংখ্যালঘু ভোটও যত দূর সম্ভব গুছিয়ে ঘরে তোলা তৃণমূলের কাছে জরুরি। শাসক দল সেই কারণে এখন বার বার হিন্দুত্বের কথা বলে। স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেন, হিন্দু ধর্মের ঠিকাদারি কারও একার নয়। বিজেপির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রামনবমী বা হনুমান জয়ন্তী পালনের সিদ্ধান্ত সেই পরিকল্পনার অঙ্গ।

এই পর্যন্ত হিসাব না-হয় বরাবর! কিন্তু বিপদঘণ্টা বাজছে অন্য কারণে। তা হলে তো মেনে নেওয়া হচ্ছে, রাম-রহিমই আসলে ভোটের তাস। কাজ নয়? উন্নয়ন নয়? দাক্ষিণ্য বিতরণের উপরেও কি ভরসা রাখা কঠিন? ভোট পেতে হলে সাম্প্রদায়িকতার কানাগলিতেই ঢুকতে হবে? কেন?

আজ বাদে কাল পঞ্চায়েত নির্বাচন। রক্তক্ষয় শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে তার চরিত্র আলাদা। লোকসভা, বিধানসভা ভোট কিন্তু তেমন নয়। সেখানে অন্য হিসাব। তৃণমূল ক্ষমতাচ্যুত হবে, তেমন বাস্তব অবস্থা এখন পর্যন্ত তৈরি হয়েছে বলে মনে হয় না। কিন্তু সাম্প্রদায়িক রাজনীতি যদি কোনও ভাবে নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠার সুযোগ পায়, জয়পরাজয়ের অঙ্ক কষতে গিয়ে যদি বিজেপির মোকাবিলায় হিন্দু, মুসলমান করতে হয়, তা হলে তা ঘোর দুর্ভাগ্যের হবে।

কেউ ফাঁদ পাতলেই সেই ফাঁদে পা দিতে হবে, কে বলল?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement