কিছু কিছু মিথ্যা ধরা কঠিন। আবার কিছু কিছু মিথ্যা বোঝা, জলের মতো সহজ। পাকিস্তান ও আফগানিস্তান হইতে বেআইনি ভাবে হুড়হুড় করিয়া ভারতে প্রবেশ করিতেছে মানুষ— এই কথার মধ্যে অসত্যের ভাগটি অধিক, অনেকে আন্দাজ করিলেও নিশ্চিত ভাবে বলিবার পথটি দেখিতে পাওয়া তাঁহাদের পক্ষে সহজ নয়। কিংবা ভারতবর্ষে স্বাধীনতার পর সত্তর বৎসরে দেশের সকল গ্রামীণ পরিবারের সত্তর শতাংশ বিদ্যুৎসংযোগ পাইয়াছে অথচ গত পাঁচ বৎসরেই সেই সংখ্যা গিয়া পৌঁছাইয়াছে ৯৫ শতাংশে— তথ্যপরিসংখ্যান দিয়া ইহাকে মিথ্যারূপে অনুধাবন করিবার কাজটি আমজনতার নহে। আবার বিপরীতে, প্রত্যেক ভারতবাসীর অ্যাকাউন্টে পনেরো লক্ষ টাকা ঢুকিবার বন্দোবস্ত হইতেছে, কিংবা দেশের অর্থনীতি বলিষ্ঠ বেগে দৌড়াইতেছে, এই সব কথায় যে একশত ভাগই জল, ফোঁটামাত্র দুগ্ধও নাই, ভারতীয় মাত্রেই জানেন। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও তাঁহাদের বিরাট অংশ অসত্যবাদী নেতার প্রতি রুষ্ট হন না, বরং তাঁহাকে সমর্থন জানান, ভোট দেন, তাঁহার পাশে থাকেন। নেতার বিরুদ্ধতা করেন যাঁহারা, তাঁহাদের সঙ্গে প্রবল উদ্যমে ও উত্তাপে লড়িয়া যান। লড়িতে গিয়া তাঁহাদের কাছে বহু ক্ষেত্রেই নেতার কথার সত্যতা প্রমাণ করিবার কাজটির অপেক্ষা যুক্তি হিসাবে অধিক আকর্ষক হইয়া দাঁড়ায়— নেতা যাহাই বলুন, তিনি নেতাকে মানেন এবং মানিবেন— এমন একটি বাক্য। চারিপাশে কান পাতিলে, সোশ্যাল মিডিয়ার আলাপআলোচনার ধারায় মনঃসংযোগ করিলে, সুতরাং বিস্মিত ও প্রশ্নাকুল হওয়া সম্ভব— তবে কি রাজনীতিকেরা মিথ্যাবাদী হইলে মানুষের কিছু যায়-আসে না?
কেবল ভারতের ক্ষেত্রে কেন। বিশ্ব জুড়িয়া এই মুহূর্তে ‘পোস্ট-ট্রুথ’ রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত, ও অ-‘সত্যাগ্রহী’ নেতাদের অতিস্পর্ধিত বিজয়কেতন। গত সপ্তাহেই হইহই করিয়া আরও এক বার ভোটে জিতিয়া আসিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, যিনি স্পষ্টতই একের পর এক মিথ্যা দাবি করিয়া গিয়াছেন ব্রেক্সিট বিষয়ে, ক্যামেরার সামনে দাঁড়াইয়া অম্লানবদনে ‘ভুল’ তথ্য দিয়াছেন। পরিস্থিতি নিজের বিপক্ষে যাইতে পারে আশঙ্কা করিয়া পার্লামেন্ট অধিবেশন অসাংবিধানিক ভাবে বন্ধ করিয়া দেশের সুপ্রিম কোর্টের রোষের লক্ষ্য হইয়াছেন। দেশের নির্বাচন প্রমাণ করিল, তাহাতে তাঁহার জনপ্রিয়তায় ছেদ পড়ে নাই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিমধ্যে ভুবনখ্যাত হইয়া উঠিয়াছেন মিথ্যাভাষণের জন্য। গণনা করিয়া নাকি দেখা গিয়াছে, অন্তত তেরো হাজার ভুল/মিথ্যা/বিভ্রান্তিকর কথা তাঁহার মুখে শোনা গিয়াছে মাত্র তিন বৎসরের মধ্যে। অথচ এই সব নেতারা কেবল সমর্থন অটুট রাখিতেছেন না, পৃথিবীর বৃহত্তম ও মহত্তম গণতন্ত্রগুলিতে তাঁহারা আবার নূতন করিয়া জিতিতেছেন, বা জিতিবার উপক্রম করিতেছেন। গণতন্ত্র তাঁহাদের নিবৃত্ত করে নাই, গণতন্ত্র তাঁহাদের জন্য লজ্জিত হয় নাই, গণতন্ত্র তাঁহাদের প্রতিনিধিত্ব মানিয়া চলিতে চাহিয়াছে। তবে কি এই সিদ্ধান্ত করা যায় যে, সত্য কিংবা সততা বস্তুটির গ্রহণযোগ্যতা লইয়াই বরং ভাবিবার দিন আসিয়াছে? সত্য এবং অসত্য পাশাপাশি দাঁড়াইলে মানুষ যে নিশ্চিত ভাবে সত্যকে সহজে লইবে, এবং তাহার পক্ষ বরণ করিবে, এমনটি অনুমান করিবার অবকাশ আর নাই?
কিছু কাল ধরিয়া এ বিষয়ে গবেষকদের দৃষ্টি ধাবিত হইয়াছে। কিছু কিছু গবেষণাকেন্দ্র সমীক্ষা চালাইতেছে। এমনই একটি সমীক্ষা মিলিয়াছে মার্কিন দেশের কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটির তরফে, যাহা হইতে সিদ্ধান্ত টানা সম্ভব যে বিশাল সংখ্যক সাধারণ মানুষ বহু কাল ধরিয়া এক ধরনের রাজনৈতিক (ও আর্থ-সামাজিক) বৃত্ত হইতে দূরে থাকিবার ফলে এক অনিরাপত্তাবোধে ভুগিতেছেন, ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত বোধ করিতেছেন। তাঁহাদের কাছে রাজনৈতিক ও সামাজিক এলিট-এর বিরুদ্ধতা করিবার রাস্তাটিই হইল এই ধরনের ‘ডেমাগগ’ নেতার প্রতি অবিরত, শর্তহীন, দৃঢ় সমর্থন। সত্য-মিথ্যার বিবেচনার অপেক্ষা তাঁহারা অনেক বেশি মূল্য দেন এই ‘নিজের মতো নেতা’ পাইবার বিষয়টিকে। ‘অনেস্টি’র জায়গা লইতে শুরু করে ‘অথেনটিসিটি’— যদিও সম্ভবত সেই অথেনটিসিটি বা ‘নিজের মতো’ ভাবনাটির মধ্যেও সত্যতার ভাগ অতীব স্বল্প! নেতাকে যে কারণে জনতা ‘নিজের মতো’ ভাবিতেছেন, সেই কারণটিও হয়তো বানাইয়া তোলা, কিন্তু তবু মানুষ ‘বানাইবার’ ঘটনাটি উপেক্ষা করিতে পছন্দ করেন। সুতরাং, চায়ের কাপে তুফান উঠিতে শুরু করে।
যৎকিঞ্চিৎ
এনআরসি-সিএএ নিয়ে হইহইয়ের মধ্যে এক সেলেব-নারী সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘উষ্ণ’ ছবি দিলেন। ছাত্রবিক্ষোভ দেখে উদ্বিগ্ন এক নায়ক টুইটে লিখে বসলেন, ভারত বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ গণতন্ত্র! আর এক জন ভারতের ভুল মানচিত্রের ছবি শেয়ার করে থতমত। এক জন দিলেন সংবিধানের আদি প্রস্তাবনার ছবি, যেখানে ‘সেকুলার’ শব্দটাই নেই। বোঝা গেল, এঁরা অভিনয় জানেন, হোমওয়ার্ক জানেন না। কোন সময় কোনটা বাজারে ছাড়তে হয়, নেতাদের দেখে শিখে নিলেও তো পারতেন!