প্রতীকী ছবি।
হাথরসের স্মৃতি এখনও মিলাইয়া যায় নাই। ইহার মধ্যেই ধর্ষণকাণ্ডে বদায়ূঁ সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে স্থান করিয়া লইল। শুধু ধর্ষণই নহে, নৃশংসতার বিচারে এক মধ্যবয়সি মহিলার এই ঘটনাটি আবারও দেশকে স্তম্ভিত করিল। অত্যাচারের ধরনে নির্ভয়া-কাণ্ডের কথা মনে পড়িতে পারে। জানা গিয়াছে, নৃশংস অত্যাচারের ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই মৃত্যু হইয়াছে ধর্ষিতার। এ ক্ষেত্রেও পুলিশের ভূমিকাটি হাথরসের কথা মনে করাইয়া দেয়। ময়নাতদন্তের জন্য দীর্ঘ টালবাহানা; অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও খুনের মামলা দায়ের করিতে বিলম্ব। নারীরা ক্রমশ বুঝিয়া লইতেছেন যে, ধর্ষণ-নিগ্রহেই তাঁহাদের যন্ত্রণা ফুরাইবার নহে— পুলিশের অসংবেদনশীলতাও তাহার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
তবে, রাষ্ট্রযন্ত্রের অপদার্থতার বৃহত্তম নিদর্শনটি এই ক্ষেত্রে পুলিশ পেশ করে নাই। সেই কৃতিত্ব রাজ্যের মহিলা কমিশনের এক সদস্যের। তিনি বলিলেন, সন্ধ্যাবেলা একা ওই মহিলা বাহির না হইলে এমন ঘটনা ঘটিত না। কথাটি যতই অসার হউক, উত্তরপ্রদেশের অবস্থাবিচারে ফেলনা নহে। প্রশাসন যেখানে মহিলাদের নিরাপত্তা বিধানে চূড়ান্ত ব্যর্থ, সেখানে মহিলারা নির্ভয়ে বাহিরে ঘুরিবেন কী উপায়ে? বস্তুত, দেশের বিভিন্ন রাজ্য প্রশাসনের ভাবিয়া দেখা দরকার, সেখানে নারীর অবস্থা কী রূপ শোচনীয়। অতীতে নির্ভয়াকাণ্ডের পরেও এই অভিযোগ শুনা গিয়াছিল— কী প্রয়োজন ছিল গভীর রাতে পুরুষসঙ্গীর সহিত বাহিরে ঘুরিয়া বেড়াইবার? এখন দেখা যাইতেছে, গভীর রাতে তো বটেই, সন্ধ্যাতেও মেয়েরা নিরাপদ নহেন। এমনকি পুরুষের উপস্থিতিও যে সর্বদা তাঁহাকে নিরাপত্তা জোগাইতে পারিবে, এমনও নহে। অতঃপর কোনও নারী পথে বাহির হইতে চাহিলে তাঁহার হয়তো লেঠেল বাহিনীর প্রয়োজন পড়িবে। জেঠামহাশয়রা নিদান দিবেন, বাহিরে পা রাখিবার সময় তাঁহার পোশাক কেমন হওয়া উচিত, কোন কোন আচরণ তিনি করিলে পুরুষের চোখে ধর্ষণযোগ্য প্রতিপন্ন হইবেন না, কোন কোন পেশায় তাঁহার না যাওয়াই সমীচীন। বস্তত, এই সমাজে ধর্ষণ হইলে এখন আইনশৃঙ্খলার অবনতি লইয়া চর্চাটি ম্লান হইয়া মহিলাদের আচরণবিধি সংক্রান্ত কথাই অধিক চলিতে থাকে। ঘটনা হইল, এ দেশের দুর্দমনীয় পুরুষ-সমাজ যতই ‘চিন্তান্বিত’ হইতেছে, ধর্ষণের সংখ্যা এবং নৃশংসতা ততই বৃদ্ধি পাইতেছে।
উত্তরপ্রদেশ তাহার মধ্যেও বিশিষ্ট। যোগী আদিত্যনাথের সরকার নিজের কার্যবিধি ও ভাবনাচিন্তার একটি পরম্পরা স্থির করিয়াছে বলিয়া অনুমান করা যাইতে পারে। তাঁহারা গরুর নিরাপত্তা বিধানে যত সচেষ্ট, লাভ জেহাদ রুখিতে যত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তাহার কানাকড়িও নারী-সুরক্ষার প্রশ্নে খরচ করিতে নারাজ। তাঁহারা হয়তো মনে করেন, গৃহাভ্যন্তরে প্রহৃত হওয়া এবং গৃহের বাহিরে ধর্ষিত হওয়া নারীজন্মের স্বাভাবিক পরিণতি। তাঁহারা জানেন, আলাপ-আলোচনা, প্রতিবাদ, সকলই মায়া। সকলই মাত্র কিছু কালের জন্য। অতঃপর প্রশাসন নিজের ‘কাজ’-এ মন দিবে, নারীকে ধান কাটিতে যাইতে হইবে। কপালে থাকিলে পুরুষের লালসার শিকার হইয়া ছিন্নভিন্ন দেহ লইয়া পড়িয়া থাকিতে হইবে রাস্তার ধারে, ধানের খেতে। কুছ পরোয়া নাহি। উন্নত, আধুনিক ভারত আগাইয়া চলিতেছে, চলিবে।