কলেজপড়ুয়ারা মাদকের নেশায় বুঁদ হইতেছে, সমস্যা শুধু সেটুকুই নহে। তাহারা মাদক বিক্রয়ের কাজেও হাত পাকাইয়াছে। নেশার টাকা জোগাড় করিবার সহজ রাস্তা। তাহাতে পুলিশের কাজ কঠিনতর হয়, সন্দেহ নাই। যেহেতু কার্যত প্রতি দিনই নূতন নূতন ছেলেমেয়ে মাদক বিক্রেতা হইয়া উঠিতেছে, ফলে নজরদারি দুষ্কর। কিন্তু, এই অজুহাতে দায় এড়াইবার উপায় পুলিশের নাই। স্কুল-কলেজের পড়ুয়ারাও যেখানে জানে কাহার নিকট নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্য মিলিবে, তখন পুলিশই বা জানিবে না কেন? বস্তুত, এই ব্যবসায় জড়াইয়া পড়া প্রতিটি ছেলেমেয়েকেই চিহ্নিত করিবার দায়ও পুলিশের নাই। তাহারা জানুক যে পুলিশ নজর রাখিতেছে— সেটুকুই যথেষ্ট হইবে। এবং, এই ছেলেমেয়েগুলির হাতে বিক্রয়ের জন্য মাদক যাহারা তুলিয়া দেয়, সেই পান্ডাদের চিহ্নিত করিবার কাজটি তুলনায় সহজতর। সেই কাজটিও পুলিশ করে না কেন? দুইটি সম্ভাব্য উত্তর আছে। এক, এই প্রাথমিক দায়িত্ব পালনের মতো দক্ষতা, তৎপরতাও পুলিশের আর অবশিষ্ট নাই; এবং দুই, ভিন্ন কোনও প্রাপ্তির আশায় পুলিশ হাত গুটাইয়া থাকে। কোন উত্তরটি তুলনায় সম্মানের, কর্তারা বাছিয়া লইতে পারেন। তবে, কেহ যদি দুইটি উত্তরকেই সমান সত্য বলিয়া ধরিয়া লন, আপত্তি করিবার বিশেষ কারণ থাকিবে না।
যে কলেজগুলিতে এই কাণ্ড চলিতেছে, দায় তাহাদের উপরও বর্তায়। নার্কোটিক কন্ট্রোল ব্যুরো যে কলেজগুলির নাম প্রকাশ করিয়াছে, সেগুলি নেহাত ফেলনা নহে। বহু অর্থের বিনিময়ে অভিভাবকরা সেখানে সন্তানদের পাঠান। সেই প্রতিষ্ঠানগুলির চার দেওয়ালের মধ্যেই মাদকের ব্যবসা চলিতেছে। ছাত্রছাত্রীরা ধরা পড়িবার পর কলেজ কর্তৃপক্ষ উত্তেজিত হইয়াছেন। কিন্তু, তাঁহাদের নাকের ডগায় এত দিন এই অপকর্ম কী ভাবে চলিল, সেই উত্তর তাঁহারা দেন নাই। ‘জানিতাম না’ বলিয়া দায় এড়াইবার উপায় নাই। জানিতেন না কেন, সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে হইবে, কারণ কলেজে কী চলিতেছে, ছেলেমেয়েরা কী করিতেছে, তাহা জানা কলেজ কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। কলেজের চৌহদ্দিতে কর্তৃপক্ষই ছাত্রদের সর্বোচ্চ অভিভাবক, তাহাদের ভালমন্দ দেখিবার অধিকারী। কেহ অনুমান করিতেই পারেন যে মাদক ব্যবসার অনাচার সম্বন্ধে কলেজগুলির কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিলেন না, বরং তাঁহারা চোখ বুজিয়া থাকাকেই শ্রেয় জ্ঞান করিয়াছেন। ব্যবসায়িক স্বার্থ আসিয়া দায়িত্ববোধকে লইয়া গিয়াছে। কলেজগুলি ব্যবসার নেশায় বুঁদ।
এনসিবি-র দফতরে ছয়টি ছেলেমেয়ের সহিত আরও কয়েক জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ মাথা নত করিয়া বসিয়া ছিলেন। তাঁহারা এই ছেলেমেয়েগুলির অভিভাবক। প্রত্যেকেই সফল, উচ্চবিত্ত। সন্তান যে কবে নেশার পথে হাঁটিতে আরম্ভ করিয়াছে, কোন দিন মাদক ব্যবসায়ের পদাতিকে পরিণত হইয়াছে, তাঁহারা জানিতেও পারেন নাই। এই অভিভাবকরাই বা দায়িত্ব অস্বীকার করিবেন কী ভাবে? তাঁহারা সন্তানের জন্য ‘ভাল’ কলেজের ব্যবস্থা করিয়াছেন, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে টাকা জোগাইয়াছেন। কিন্তু, সময় দেন নাই। তাহাদের জগতের অংশ হইতে চেষ্টা করেন নাই, সন্তানদেরও নিজেদের জগতে প্রবেশাধিকার দেন নাই। নিজেদের লইয়াই তাঁহারা বুঁদ হইয়া ছিলেন। এই অসুখ এখন মহামারি হইয়াছে। বহু গৃহকোণই এখন কয়েকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের সমাহার। পরিবার মানে যে শুধু জৈবিক সম্পর্ক নহে, পেশাকে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি সন্তানকেও যে সময় দেওয়া প্রয়োজন, এই প্রাথমিক কথাগুলিও বর্তমানের বহু সফল মানুষ ভুলিয়াছেন। কোন কাজটি ভাল, আর কোনটি মন্দ, সন্তানের মধ্যে এই বোধ যদি পারিবারিক পরিসর তৈরি না করিয়া দিতে পারে, তবে এই পরিণতি ঠেকাইবে কে? পুলিশের পাহারায় তত জোরও নাই।