নারিকেল যেন বৃক্ষকুলে রাজা হর্ষবর্ধন— নিজের যথাসর্বস্ব দিয়া পরোপকার করিয়া যায়। কাণ্ড, পাতা, ফল সকলই দিয়া খাদ্য-জ্বালানি-বাসস্থানের প্রয়োজন মিটাইতেছে। ফল বলিলেই মনে আসিয়া পড়ে আপেল, অথবা আম। অথচ তাহাদের অনেক উপরে রহিয়াছে নারিকেল। কেবল গাছের উচ্চতার জন্য নহে। নারিকেলই সেই ফল, যাহার জন্য বিশ্ব বরাদ্দ করিয়াছে একটি দিবস। প্রতি বৎসর ২ সেপ্টেম্বর দিনটি বিশ্ব নারিকেল দিবস বলিয়া পালিত হয়। প্রশ্ন উঠিতে পারে, একটিমাত্র দিন কি যথেষ্ট? ঝাঁটা-দড়ি সরবরাহ হইতে নির্মল তৈল, সুমিষ্ট জল ও সুস্বাদু ফল, কী না জোগাইতেছে। ভারতীয় উপকূল জুড়িয়া নারিকেলের সারি অগণিত মানুষের জীবিকার সুরক্ষাও জোগাইতেছে, জীবনযাপনের অত্যাবশ্যক সামগ্রীও জোগাইতেছে। নারিকেলের গুণ কেবল তাহার আর্থিক মূল্যেও সীমাবদ্ধ নহে। নারিকেল বাঙালির ঐকমত্যের প্রতীক। বাঙালির রসনাবল্লভ কে, ইলিশ না কি চিংড়ি, সেই বিতর্ক শেষ হইবার নহে। কিন্তু দুগ্ধফেননিভ নারিকেল কোরার স্পর্শ না থাকিলে মৎস্যরাজের অভিষেক সম্পন্ন হইবে না, সেই বিষয়ে কোনও প্রশ্ন উঠিতেই পারে না। চিংড়ির মালাইকারি অথবা সরিষা-ইলিশ, লবণ-হরিদ্রার মতোই নারিকেলের স্পর্শও আবশ্যক। নিজেকে প্রচ্ছন্ন রাখিয়া অপরের সেরা গুণটি প্রকাশ করিতে পারে নারিকেল। আম-কাঁঠাল, বাঙালির প্রিয় দুইটি ফল, আদ্যন্ত আধিপত্যবাদী। আম তাহার স্বাদ, আর কাঁঠাল তাহার গন্ধ দিয়া অপরকে নস্যাৎ করিতে চাহে। নারিকেল কিন্তু অকিঞ্চিৎকর কচুটিকেও মহিমান্বিত করিয়া তোলে। আজিকার দ্বন্দ্বদীর্ণ জগতে এই গুণটিই কি সর্বাপেক্ষা বরণীয় নহে?
প্লেটোর আদর্শে গঠিত সমাজে রাজার স্থানটি নারিকেলই পাইত। নিজেকে জাহির করিতে সে নিতান্ত অনাগ্রহী। শাখা-প্রশাখা মেলিয়া, বাড়তি শিকড় নামাইয়া, সন্তানসন্ততির সহিত নিজেকে অবিচ্ছিন্ন বলিয়া দেখাইয়া কয়েক প্রজন্মের পরিবারতন্ত্র ফাঁদিয়া বসে না। নারিকেল স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী, নিজের একটিমাত্র কাণ্ডে নির্ভর করিয়া সে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া থাকে। গণতন্ত্রের পক্ষে নারিকেলই সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত। সংসারের পক্ষেও বটে। বঙ্কিমচন্দ্র নারীর বুদ্ধির সহিত আধখানা মালার তুলনা করিয়াছেন। কমলাকান্ত নেশামুক্ত চক্ষে চাহিলে হয়তো অপর সাদৃশ্য দেখিতে পাইত। বাঙালির যৌথ পরিবারের বিধবা, পরিত্যক্তা নারীদের বাহিরের আবরণটি ছিল কঠিন, নিশ্ছিদ্র আচার-বিচারে আবৃত। অভ্যন্তরে স্নেহ-ভালবাসার নরম স্তর, তাহারও ভিতরে গোপন অশ্রুজল। বুক না ফাটিলে তাহা কেহ দেখিতে পাইত না।
এই দুঃখিনী পিসি-মাসিদের প্রাণে সঞ্চিত সুধার সন্ধান পাইত কিছু পালিত প্রাণী, আর শিশুরা। এই মানুষগুলি সংসারের কল্পবৃক্ষ। আজও তাঁহাদের সংখ্যা কম নহে। তবে ঝুনা নারিকেলও কম নাই। শ্রীরামকৃষ্ণ সংসারে থাকিয়াও নিরাসক্ত ব্যক্তিদের ঝুনা নারিকেলের সহিত তুলনা করিয়াছিলেন। বয়স বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে শাঁস শক্ত হইয়া খোল হইতে আলগা হইয়া গিয়াছে। লোকচক্ষে কচি ডাবের ন্যায় মনোরম নহে ঝুনা নারিকেল, কিন্তু তাহার সম্পদ অধিক। তাহার জল শুকাইয়া মহামূল্য তৈল হইয়াছে। তবে তাহা দান করিতে নিষ্কাশনের বেদনাও সহিতে হইবে। ইহাও হয়তো নারিকেল দিবসের বার্তা।