অনাদর। সিউড়ি। মে ২০১৩। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়
রাজ্য জুড়ে কতগুলো পুরসভায় নির্বাচন হচ্ছে? রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে যে তথ্যই থাক, পশ্চিমবঙ্গের, বিশেষ করে কলকাতার কোনও সাধারণ নাগরিক যদি উত্তরে ‘এক’ বলেন, দোষ দেওয়া যাবে না। ১৮ ও ২৫ এপ্রিল, দু’দিনে রাজ্যের মোট ৯২টি পুরসভায় ভোট হওয়ার কথা থাকলেও ধারে, ভারে ও প্রচারে কলকাতা পুরসভা একাই একশো। কেবল মিডিয়ার প্রচারে নয়, এই প্রবণতা এমনকী রাজনৈতিক দলগুলোর পুর-নির্বাচনী ইস্তাহারেও। অধিকাংশ দলের ইস্তাহারে কলকাতা হি কেবলম্।
কলকাতা গুরুত্বপূর্ণ। আজও গোটা পূর্ব ভারতের এক নম্বর শহর। কলকাতা দখল করলে আগামী দিনে রাজ্য দখল করার বা দখলে রাখার সুবিধে হয়। কিন্তু বাকি একানব্বইটি শহরকে প্রায় কোনও পাত্তা না দিয়ে কলকাতাকেন্দ্রিক এই রাজনৈতিক একচোখোমি অত্যন্ত বিপজ্জনক প্রবণতা। শুধু বিভিন্ন শহরে নাগরিক পরিষেবার পরিকল্পনা ও রূপায়ণের পক্ষেই নয়, গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের প্রশ্নেও। আসলে যেমন কিছু সর্বভারতীয় নেতা দিল্লির বাইরে কিছু ভাবতে পারেন না, তেমনই বিভিন্ন দলের নেতৃত্বে থাকা কলকাতাকেন্দ্রিক নেতা ও নেত্রীরা কলকাতার বাইরে ভাবতে পারেন না, চানও না। অথচ, কলকাতা পুরসভা এলাকায় মোটামুটি পঁয়তাল্লিশ লক্ষ মানুষের বাস, আর বাকি একানব্বইটি পুরসভার এলাকায় অধিবাসীর সংখ্যা এক কোটির কাছাকাছি।
শাসক দলের কথাই প্রথমে বলি। তৃণমূল কংগ্রেসের ওয়েবসাইটে বিভিন্ন ভাষায় জ্বলজ্বল করছে কলকাতা পুরসভার বিগত বোর্ড কী কী করেছে এবং ক্ষমতায় ফিরে এলে আগামী পাঁচ বছরে কী কী করবে তার খতিয়ান। শিলিগুড়ি ও সিউড়ি পুরসভা এলাকার জন্য কয়েক পাতার ইস্তাহার বার করলেও তা হচ্ছে প্রধানত যথাক্রমে ব্যক্তি অশোক ভট্টাচার্য ও বিক্ষুব্ধ বিধায়ক স্বপনকান্তি ঘোষকে ঠেকানোর তাগিদে। কিন্তু দলের ওয়েবসাইটে কলকাতার পাশাপাশি তাদের স্থান হয়নি। বিজেপিও তৃণমূলের বি-টিম, তাদের ঘোষণাপত্রের উপরে স্পষ্ট লেখা: কলকাতা পৌরসংস্থার নির্বাচন ২০১৫। বামফ্রন্টের নির্বাচনী ইস্তাহারে কলকাতার কথা স্পষ্ট করে উল্লেখ করা না থাকলেও তাতে কলকাতাকেন্দ্রিক ভাবনাটাকে খুব সহজেই চিনে নেওয়া যায়। অবশ্য সেটি এমন ভাবে লেখা যে, তাকে যে কোনও উন্নয়নশীল দেশের বা শহরের নির্বাচনী ইস্তাহার বলে চালিয়ে দেওয়া যায়, আবার উচ্চ মাধ্যমিকের মডেল রচনা বললেও কোনও ক্ষতি নেই।
সম্প্রতি চন্দননগরে ‘সবুজের অভিযান’ নামক একটি সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত এক সভার আলোচ্য ছিল: পুরনির্বাচনের ইস্তাহারে পরিবেশ ভাবনা। সেখানে বিজেপি প্রতিনিধি গঙ্গা থেকে আসা অপরিশোধিত জলের ব্যবহার নিয়ে সওয়াল করে গেলেন, অথচ কলকাতার জন্য তাঁর দলের প্রচারিত নির্বাচনী ইস্তাহারে অপরিশোধিত জলের ব্যবহারকে ‘বড় কেলেঙ্কারি’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
প্রতিটি শহরের নিজস্ব চরিত্র আছে, নিজস্ব শক্তি ও দুর্বলতার জায়গা আছে, নিজস্ব প্রয়োজন আছে। সবার জন্য ‘কলকাতা মডেল’ চলবে কেন? যেমন ইস্তাহারে তৃণমূল কংগ্রেস কম্প্যাক্টর-এর সাহায্যে আবর্জনা পরিষ্কারের উদ্যোগ বাড়ানোর কথা বলেছে। বিজেপিও বলেছে আবর্জনা থেকে সার ও বায়োগ্যাস তৈরির কথা, হাসপাতালের বর্জ্যকে আলাদা রাখার কথা। বামফ্রন্টের ইস্তাহার বলছে ‘শহরকে পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন এবং বর্জ্য পদার্থ মুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।’ কামারহাটির সেই ছ’লক্ষ মানুষের কী লাভ এই সব প্রতিশ্রুতি শুনে, যাঁরা প্রতিদিন যাওয়া-আসার পথে আবর্জনার স্তূপ দেখতেই অভ্যস্ত? অধিকাংশ পুর এলাকাতেই আবর্জনা ফেলার ন্যূনতম জায়গা নেই। ম্যানিফেস্টোরা কলকাতায় পরিষেবার উন্নতির জন্য মোবাইল অ্যপ বা অনলাইন অভিযোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, আর গয়েশপুর বা কালনার মতো পুরসভা হয়তো বড়বাবু, হাতে গোনা কয়েক জন আধিকারিক ও এক জন স্যানিটরি ইনস্পেক্টরের হাত ধরে চলে।
পশ্চিমবঙ্গে নগর উন্নয়নের ছবিটা এ-রকমই ভারসাম্যহীন। অধিকাংশ তথাকথিত উন্নয়নের ঠিকানা হচ্ছে কলকাতা, ছোট শহরগুলো ধুঁকতে ধুঁকতে কলকাতা হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় শান দিচ্ছে। কলকাতায় দশটির পাশাপাশি হাওড়ায় একটি বা বারাসতে আধখানা শপিং মল হচ্ছে, কিংবা গারুলিয়া বা নিউ ব্যারাকপুরে হয়তো নীল-সাদা রেলিং বা ত্রিফলা আলো বসছে, ওই পর্যন্তই। শ্রীরামপুর বা চন্দননগরের মতো শহর নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সেরা ‘হেরিটেজ শহর’ হতে পারত, তারাও কলকাতার অন্ধ অনুকরণে ব্যস্ত থেকে নিজস্বতা হারাচ্ছে। মহেশতলা বা সল্ট লেককে কলকাতার সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার ভাবনাটাও এখান থেকেই আসছে। কলকাতা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু বাকি শহরদের কলকাতা বানানোর চেষ্টা করলে তাদের ক্ষতি, কলকাতারও। এক সময় গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার কথা শোনা যেত। আসলে এখন দরকার ছোট শহরগুলি দিয়ে কলকাতাকে ঘেরা, সে জন্য তাদের নিজের নিজের মতো করে উন্নয়ন করতে দিতে হবে। রাজনীতিকরা সে কথা শুনবেন, এমন ভরসা অবশ্য কমই।