সম্পাদকীয় ১

কণ্ঠরোধের তন্ত্র

বন্দি দশাতেই মৃত্যু বরণ করিয়া লইলেন চিনা লেখক-দার্শনিক লিউ শিয়াওপো। এই দীর্ঘ কারাবরণের হেতু: তিনি প্রতিবাদী, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করিয়াছিলেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
Share:

নোবেল পুরস্কার অনুষ্ঠানে চেয়ারটি ফাঁকা পড়িয়া ছিল। ২০১০ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার তিনি নিজ হাতে গ্রহণ করিতে পারেন নাই, তখন তিনি জেলে ছিলেন। দুরারোগ্য ব্যাধি ধরা পড়িল, কিন্তু প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করাইতে পারিলেন না, কেননা তখনও তিনি বন্দি। শেষ পর্যন্ত গুরুতর অসুস্থতার জন্য তাঁহাকে জেল হইতে হাসপাতালে পাঠানো হইল, অন্তরিন অবস্থায়। অর্থাৎ বন্দি দশাতেই মৃত্যু বরণ করিয়া লইলেন চিনা লেখক-দার্শনিক লিউ শিয়াওপো। এই দীর্ঘ কারাবরণের হেতু: তিনি প্রতিবাদী, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করিয়াছিলেন। চিনের একদলীয় শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে বহুদলীয় রাজনীতি ও নির্বাচন পদ্ধতি দাবি করিয়াছিলেন। বাক্-স্বাধীনতার সওয়াল করিয়াছিলেন। অর্থাৎ ‘পিপলস রিপাবলিক অব চায়না’ ঠিক যে যে বিষয়ে জিতেন্দ্রিয়, ইন্দ্রিয়-প্রকাশিত কোনও বক্তব্য গ্রাহ্য করায় বিশ্বাস করে না, সেই দাবিগুলির পক্ষেই লিউ লেখালিখি বলাবলি করিতেছিলেন। এই মহাপাপের মহাশাস্তি আক্ষরিক অর্থে তিনি আজীবন ভোগ করিলেন। বেজিং-এর কাছে তাঁহাকে লইয়া বহু অনুরোধ, উপরোধ পৌঁছাইয়াছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন হইতে নেলসন ম্যান্ডেলা, দলাই লামা, ডেসমন্ড টুটু, রথী মহারথীরা লিউ-এর মুক্তির প্রার্থনা জানাইয়াছেন। ভবী ভোলে নাই। তিয়েনআনমেন স্কোয়্যার হইতে শুরু করিয়া ২০০৮ সালের একদলীয় শাসনব্যবস্থার প্রতিরোধ আন্দোলন ‘চার্টার ০৮’, এই লম্বা পথ ধরিয়া যে লিউ শিয়াওপো চিনা কমিউনিস্ট পার্টির দৃঢ়তম সমালোচকে পরিণত হন, এগারো বৎসর তিনি চিকিৎসার জন্যও কারাগারের বাহিরে পা রাখিতে পারেন নাই।

Advertisement

এই মৃত্যুর পরে আরও এক বার চিনের ভয়‌ংকর রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদের বিপক্ষে কঠোর সমালোচনায় নামিয়াছে গোটা বিশ্ব, ভারতও। সংগত ভাবেই। চিনা নাগরিকদের জীবনধারণের পদে পদে স্বাধীনতার অভাব কতখানি, তাহা হয়তো বাহিরের পৃথিবী সম্যক বুঝিতেও পারে না। কণ্ঠরোধের পদ্ধতিটি সে দেশে এতটাই প্রাতিষ্ঠানিকতায় পরিণত যে, ধরিয়া লওয়া যায় লিউ-এর সংবাদ বাহিরে প্রচারিত হইলেও এমন আরও অসংখ্য সংবাদ বাহিরে আসিবার কোনও উপায় নাই। প্রসঙ্গত, ১৯৯০-এর দশক হইতেই চিনের ব্যক্তিস্বাধীনতা দমন প্রবল পর্যায়ে ওঠে, আবার সেই দশক হইতেই কিন্তু চিন অর্থনৈতিক অগ্রগতির মুখ দেখে, বাজার অর্থনীতির সঙ্গেও তাহার নীরব যোগাযোগ ঘটে। অর্থনৈতিক প্রসার আর সামাজিক মুক্তির পারস্পরিক সম্পর্কটিকে চিন নূতন করিয়া ভাবিতে বাধ্য করিয়াছে। এই চিনা ফাঁদের কথা নিরন্তর শোনা যায় অমর্ত্য সেন-এর মুখে, উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের দূরত্ব লইয়া তাঁহার সতর্কবার্তায়।

লিউ ভাবিয়াছিলেন, একদলীয় শাসন অপসারণের মধ্যেই গণতন্ত্রের পথ অভ্রান্ত। তাঁহার ভাবনা ভুল না হইলেও আংশিক ভাবে ঠিক। বহুদলীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতেও গণতন্ত্রের পথ কখনও কখনও রুদ্ধ হইতে পারে— রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগের পথ দিয়া, সংখ্যাগুরুর কর্তৃত্ববাদের পথ দিয়া, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করার মধ্য দিয়া। গণতন্ত্রের অর্থ নাগরিক মুক্তি, বাক্-স্বাধীনতা যাহার প্রাথমিক শর্ত। এক দল বা বহু দল শুধুই গণতন্ত্রের সূচনাবিন্দু। কিন্তু তাহার লম্বা পথ যে কত পিচ্ছিল হইতে পারে, কত খাদ ও ফাঁদ সেই পথে থাকিতে পারে, তাহা এক অন্য কাহিনি। চিনে গণতন্ত্র নাই, অন্য দেশে আছে, এই ভাবিয়া তাই অন্যান্য দেশের নাগরিকরা সাত তাড়াতাড়ি চিনের সমালোচনায় প্রবৃত্ত না হইলেই মঙ্গল। ক্ষমতার মাত্রাতিরিক্ত, প্রতিরোধহীন প্রয়োগ গণতন্ত্রের বীজ, চারা বা বৃক্ষকেও যে কোনও দিন সমূলে উপড়াইয়া ফেলিতে পারে, ভুলিয়া গেলে সমূহ বিপদ। বিশেষত সাম্প্রতিক ভারতে বসিয়া।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement