চার দশকের পুরাতন সংবিধান বদলাইতে চলিয়াছে চিলিতে। গত বৎসর হইতেই দেশে প্রবল নাগরিক আন্দোলন চলিতেছিল। পুলিশ ও জনতার সংঘর্ষ হইয়াছে, প্রাণহানিও। মানুষের দাবি ছিল, গণভোট হউক, নাগরিকরাই জানাইবেন দেশের সংবিধান পাল্টানো প্রয়োজন কি না। জেনারেল আউগুস্তো পিনোশে-র সামরিক জমানার সংবিধানে এই কালেও দেশ চলিবে, তাহা হইতে পারে না, কারণ উহা গণতান্ত্রিক ও সর্বজনীন নহে। বিস্তর টালবাহানার পরে বর্তমান প্রেসিডেন্ট গণভোটে মত দিয়াছেন। গণভোটে ৭৮ শতাংশেরও বেশি মানুষ সংবিধান পাল্টাইবার পক্ষে মত দিয়াছেন। রাজধানী সান্টিয়াগোর রাজপথে ‘জনতার জয়’ উদ্যাপন করিতেছেন লক্ষ মানুষ।
‘জনতার জয়’ কেন? রাজনীতির পণ্ডিতরা বলিতেছেন, দীর্ঘ সামরিক শাসনে নিষ্পিষ্ট চিলির সাধারণ মানুষের স্মৃতিতে সমষ্টিগত জয়ের অভিজ্ঞতা নাই বলিলেই চলে। জেনারেল পিনোশে-র একনায়কতান্ত্রিক জমানার অভিজ্ঞান হইয়া দাঁড়াইয়াছিল হিংসা, অত্যাচার, রাজনৈতিক হত্যা, নির্বাসন। ১৯৮০ সালে রচিত সংবিধানে ঠিক হয়, দেশ চলিবে নব্য-উদারবাদী নীতিতে। রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ থাকিবে ন্যূনতম; বেসরকারিকরণ ও মুক্ত বাজার নীতিই হইবে চালিকাশক্তি। সময়টি লক্ষণীয়— গত শতকের আশির দশকে আমেরিকা হইতে ব্রিটেন, সর্বত্রই উদার অর্থনীতির জয়গান চলিতেছে। আমেরিকার শিকাগো ইউনিভার্সিটির ‘লিবার্টারিয়ান ক্যাপিটালিজ়ম’-এর জয়ধ্বজা পিনোশের চিলিতেও উড়িয়াছিল। কিন্তু, উদার অর্থনীতির সহিত গণতন্ত্রের বিচ্ছেদ ঘটিলে কী বিপদ ঘটিতে পারে, চিলি তাহার সাক্ষী। সে দেশে বাণিজ্যের বাড়বাড়ন্ত হইয়াছিল, প্রচুর বিদেশি সংস্থা আসিয়াছিল, কিন্তু গণতান্ত্রিকতার অভাব তাহার সুফলকে সর্বজনীন হইতে দেয় নাই। দেশে ছাইয়া গিয়াছিল বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি। পিনোশে-র কাল গিয়াছে, কিন্তু চল্লিশ বৎসর পরেও সেই সংবিধান বহাল। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পেনশনের মতো পরিষেবা বেসরকারি হাতে। তাহাও বড় কথা নহে— মূল সমস্যা হইল, ক্ষেত্রগুলি অকুশলী ভাবে পরিচালিত। জীবনযাত্রা ব্যয়বহুল। গত বৎসর নভেম্বরে মেট্রোর ভাড়া বাড়িলে মানুষের সহ্যসীমা ছাড়াইয়া যায়— তাহার পর হইতেই লাগাতার আন্দোলন, যাহার পরিণতি সংবিধান পাল্টাইতে চাহিয়া গণভোট।
চিলির নাগরিকেরা ধীর সুস্থির পদক্ষেপ করিতেছেন। পরিবর্তিত সংবিধান আসিবে ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে। তাহার পূর্বে বিস্তর কাজ রহিয়াছে। সংবিধানের খসড়া তৈরি করিবেন যাঁহারা, তাঁহারাও নাগরিকের ভোটেই নির্বাচিত হইবেন, ঠিক হইয়াছে। অর্থাৎ, এই মুহূর্তে যাঁহারা দেশের সক্রিয় নীতি-নির্ধারক, নব সংবিধান প্রণয়নের ক্ষমতা তাঁহাদের নাই। রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলি দুই মাসের মধ্যে প্রার্থী মনোনয়ন করিবে, আগামী বৎসর এপ্রিলে নাগরিকেরা ভোট দিয়া ১৫৫ জনের ‘সাংবিধানিক সভা’ নির্বাচিত করিবেন, সেখানে নারী ও পুরুষ সভ্যের লিঙ্গসাম্যও থাকিবে। এক বৎসরের ভিতরে নির্বাচিত সদস্যেরা নূতন সংবিধানের খসড়া তৈরি করিবেন। তাহার পরেও একটি গণভোট হইবে, সেখানেই নূতন সংবিধানের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হইবে। সামাজিক ভাবে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির মধ্যে দাঁড়াইয়াও কী ভাবে গণতন্ত্রের যুদ্ধ লড়িতে হয়, চিলি দেখাইল।