যোগী আদিত্যনাথ দুই ফোঁটা চোখের জল ফেলিলেন কি না, চিকিৎসক কাফিল খানকে দায়িত্ব হইতে সরাইয়া সরকার আরও এক দফা অন্যায় করিল কি না, সবই গৌণ প্রশ্ন। লাল কেল্লায় দাঁড়াইয়া প্রধানমন্ত্রী গোরক্ষপুরের শিশুমৃত্যুকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সহিত গুলাইয়া ফেলিবার সচেতন প্রয়াস করিলেন কি না, সেই প্রশ্নও অপেক্ষা করিতে পারিবে। এক্ষণে প্রধান কথা হইল, সাড়ে চুয়াল্লিশ লক্ষ মানুষের বসতি গোরক্ষপুর যদি একটি পৃথক দেশ হইত, তবে শিশুমৃত্যুর হারের নিরিখে তাহার স্থান হইত দুনিয়ার শেষ ২০টি দেশের তালিকায়। ১৮তম স্থানে। প্রসবকালে জীবিত ছিল, এমন প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে ৬২টি শিশু এক বৎসর বয়স হইবার পূর্বেই মারা যায়। সমগ্র উত্তরপ্রদেশে এই হার প্রতি হাজার শিশুতে ৪৮, গোটা দেশে ৪০। গোরক্ষপুরে প্রতি ১০০০ শিশুর মধ্যে ৭৬টি শিশু পাঁচ বৎসরের গণ্ডি অতিক্রম করে না। অর্থাৎ, গোরক্ষপুরে বিপুল শিশুমৃত্যু বিরল ঘটনা নহে। এনসেফ্যালাইটিস-এ শিশুমৃত্যুও নিয়মিত ঘটনা। বাবা রাঘবদাস মেডিক্যাল কলেজের সাম্প্রতিক মৃত্যুমিছিলটি স্বতন্ত্র শুধু ঘটনার নাটকীয়তায়। সরকারি হাসপাতাল বিল মিটায় নাই বলিয়া অক্সিজেনের জোগান বন্ধ হইয়াছে, ফলে এতগুলি শিশুর প্রাণহানি হইল— অনুমান করা চলে, এহেন চাঞ্চল্যকর অভিযোগই বর্তমান ঘটনাক্রমটিকে সর্বভারতীয় ট্র্যাজেডিতে পরিণত করিয়াছে, এমনকী মোদীও মুখ খুলিতে বাধ্য হইয়াছেন। নচেৎ, গোরক্ষপুর নামক ‘দেশ’টি মৃত্যুমিছিলে অভ্যস্ত।
ভারত যে প্রকৃতার্থে একটিমাত্র দেশ নহে, তাহার ভৌগোলিক পরিধির মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়া যেমন আছে, তেমনই সাহারা মরুভূমির দক্ষিণ দিকে থাকা দেশগুলিও রহিয়াছে— এই কথাটি অধুনা বহু-আলোচিত। গোরক্ষপুরের শিশুমৃত্যু আরও এক বার তাহা স্মরণ করাইয়া দিল। পরিসংখ্যান বলিতেছে, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান বা মধ্যপ্রদেশের ন্যায় পিছাইয়া থাকা রাজ্যে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যে অর্থ বরাদ্দ হয়, তাহা সচরাচর খরচ হয় না। অর্থাৎ, সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রতি অবহেলা অতি গভীর। এই শিশুগুলি সেই অবহেলারই শিকার হইল। ইহা গণতান্ত্রিক রাজনীতির ব্যর্থতাও বটে। আজ নাটকীয় শিশুমৃত্যুর পর সব দলই গোরক্ষপুরকে গন্তব্য করিয়াছে। অথচ, কেন এত দিন অঞ্চলটি দেশের শিশুমৃত্যু-রাজধানী হইয়া থাকিল, এই ঘটনার পূর্বে সেই প্রশ্নটি কেহ করিবার অবকাশ পান নাই। গণপরিসরে স্বাস্থ্যের প্রশ্নটি যেহেতু এতখানি অবহেলিত, নাটকীয়তা ভিন্ন যেহেতু তাহা রাজনীতির প্রশ্ন হইয়া উঠিতে পারে না, ফলে স্বাস্থ্য পরিষেবাকে অবহেলা করিতে কেহ দ্বিতীয় বার ভাবেন না। বিশেষত, যেখানে প্রশ্ন শুধু গরিবের প্রাণের, সেখানে এই অবহেলা আরও অনেক সহজ হয়।
বাবা রাঘবদাস মেডিক্যাল কলেজে যাহা ঘটিল, তাহার পিছনেও দীর্ঘ অবহেলার লক্ষণ স্পষ্ট। হাসপাতালে অক্সিজেন মজুত ছিল না কেন, সরকারি হাসপাতাল হওয়া সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় পরিষেবার বকেয়া টাকা শোধ করা হয় না কেন— সব প্রশ্নের উত্তরই আসলে সেই অবহেলা। অথবা, অবহেলা করিবার স্বাধীনতা। রাজনীতির নিকট যেহেতু স্বাস্থ্যের প্রশ্নটি ফেলনা, অতএব এই ক্ষেত্রে গণপরিসরে জবাবদিহিরও কোনও দায় কাহারও নাই। আশঙ্কা হয়, আগামী পরশুর পরের দিন যখন গণমাধ্যমের নজর ভিন্ন কোনও ঘটনায় সরিয়া যাইবে, রাজনীতির নেতারা ভিন্নতর প্রশ্ন লইয়া ব্যস্ত হইবেন, তখন গোরক্ষপুরও তাহার পরিচিত অন্ধকারে ফিরিয়া যাইবে। গণতান্ত্রিক রাজনীতি যত দিন না জনস্বাস্থ্যকে অতি জরুরি, এবং অতি রাজনৈতিক প্রশ্ন হিসাবে জ্ঞান করিতেছে, পরিস্থিতি বদলাইবে না। আদিত্যনাথরা ক্যামেরার সামনে কাঁদিয়াই রেহাই পাইবেন।