ছবি: সংগৃহীত
সমাজ গড়ার কারিগর হিসেবে গড়ে তোলাই শিক্ষার মূল কথা। আজ যারা শিশু, তারাই আগামিদিনের দেশ গড়ার কারিগরে পরিণত হবে। নেতৃত্ব দেবে দেশ তথা বিশ্বকে। নেলসন ম্যান্ডেলার পর্যবেক্ষণ ছিল— সমাজ শিশুদের প্রতি কী আচরণ করে, তার মধ্য দিয়ে সমাজের চেহারা ফুটে ওঠে। আসলে, শিশুরা কাদামাটির মতো। যত্ন দিয়ে না গড়লে তা তারা মাটির ডেলার মতোই পড়ে থাকে। প্রতিমা গড়ে ওঠে না।
বহনের ক্লান্তি
আজকের প্রেক্ষাপটে যদি শিশুশিক্ষার পরিস্থিতি লক্ষ করা যায়, তা হলে দেখা যায়, কী নিদারুণ ভাবে শিক্ষার প্রাথমিক উপকরণের বোঝা এই সব কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কাঁধে করে বয়ে নিতে যেতে হচ্ছে। বইভর্তি ব্যাগের ভার বাহকের মোট ওজনের প্রায় সমান বা কোনও কোনও ক্ষেত্রে বেশি! ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ’— এই কথা এখন কেবল পাঠ্যপুস্তক এবং আলোচনা সভাতেই শুনতে পাওয়া যায় বেশি। কিন্তু বাস্তব জীবনে আবেগের চেয়ে বেশি হয়ে ওঠে মাতৃভাষার বদলে ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাচর্চা। এর জন্য শুধু সরকারি নীতিকে দোষারোপ করে দায় এড়ানোর কোনও মানে হয় না। আমরাও সমান দোষী। অন্তত চিন্তা ও মননের দিক থেকে। আর সেই কারণে গত প্রায় দু’দশকে আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গে এবং সেই অর্থে সমগ্র ভারতেই মুড়ি-মুড়কির মতো বেড়েই চলেছে ইংরেজিমাধ্যম স্কুল। একটি বিষয় এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে প্রণিধানযোগ্য। সরকারি মাতৃভাষার বিদ্যালয়গুলিতে শিশুদের ব্যাগের ওজন বেসরকারি ইংরেজিমাধ্যম স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ব্যাগের ওজনের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। শিক্ষার বাণিজ্যকরণ যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, ততই ব্যাগের ওজন বেড়ে চলেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্কুলব্যাগের সর্বাধিক ওজন হওয়া উচিত শিশুদের শরীরের ওজনের অন্তত ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। কিন্তু বাস্তবে কি তাই হচ্ছে? একজন শিশুর ওজন যদি ২৫ থেকে ৩০ কিলোগ্রাম হয়। তা হলে ব্যাগের ওজন তিন থেকে চার কিলোগ্রাম হওয়া দরকার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ওজন তার চেয়ে বহু গুণ বেড়ে গিয়েছে ব্যাগের। নতুন সিলেবাসের ধাক্কায় যত বেশি পাঠ্যপুস্তক শিশুদের গেলানো হচ্ছে, তার সঙ্গে হোমওয়ার্কের চাপে মানসিক ভাবে ভারাক্রান্ত হচ্ছে শৈশব।
প্রতিযোগিতার ভার
শিক্ষার বেসরকারিকরণ যত দ্রুত হচ্ছে, তত সরকার অনুমোদিত এবং পোষিত বিদ্যালয়গুলির অবস্থান দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরকারি বিদ্যালয়গুলি এঁটে উঠতে পারছে না। অথচ অনেক বেশি বিজ্ঞানসম্মত ভাবে সরকারি বিদ্যালয়গুলির শিক্ষাদান সম্ভব। ব্যাগের বোঝা অন্তত বেসরকারি ইংরেজিমাধ্যম স্কুলের চেয়ে কম তো বটেই। অথচ আমরা তাও ইংরেজিমাধ্য স্কুলে কেন সন্তানদের নিয়ে যাচ্ছি, সে প্রশ্ন তো ওঠেই। শৃঙ্খলা আর ইংরেজি শিক্ষার প্রতি ঝোঁক একটা বড় কারণ অবশ্যই। কিন্তু যে ভাবে বেসরকারি স্কুল পড়ুয়াদের ঘাড়ে পাঠ্যপুস্তকের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে, তা অবশ্যই অনেকাংশেই অমানুষিক। এটা ভাবা দরকার। তীব্র প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষাব্যবস্থার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে আজকের শৈশব, খেলাধুলো সব কিছুই। শুধুই প্রথম হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। আর তাতেই ঘি ঢেলে যাচ্ছে অনেক বেসরকারি স্কুল। হয়তো শুধু তাদের দোষ দিয়েও লাভ নেই। কারণ, আমরাও তো ঘোরগ্রস্তের মতো দৌড়চ্ছি সন্তানকে নিয়ে ওই সব স্কুলেই। নিজের সন্তান কী পরিমাণ চাপের মধ্যে থাকবে, তা জেনেও ছুটে চলেছি। দোষ তো আমাদেরও। অভিভাবকেরা একদিকে অতিরিক্ত সচেতন হতে গিয়ে প্রতিযোগিতার মুখে ফেলে দিচ্ছেন নিজেদের সন্তানদের। তাঁদের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষার খেসারত দিতে হচ্ছে নবীন প্রজন্মকে। তাই সন্তানকে বইয়ের ওজন বইতে দেখেও তা নিয়ে গর্জে উঠছেন না প্রায় কেউই। শৈশব হয়ে উঠছে যান্ত্রিক। ব্যাগের ভারে চাপা পড়ছে শৈশব।
পিছন ফিরে দেখা
আমরা নিজেরা ছোটবেলায় কি এই ভাবে পড়াশোনা করেছি? আমরা তো খেলতাম, ঘুরতাম, আনন্দ করতাম। কিন্তু এখন কেন তেমন হয় না? এখন যেমন খেলার মাঠ নেই সে ভাবে, তেমনই নেই অভিভাবকের উৎসাহও। শুধুই পড়া আর পড়া। আর তার কারণ যেম, জীবনযুদ্ধে নিজের সন্তানকে দাঁড় করাতেই হবে! তবেই সেই সন্তান আর তার গর্বিত পিতামাতা সফল! কিন্তু এই তথাকথিত সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে সন্তানের শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা যে করুণ হয়ে উঠছে! তারা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। ব্যাগের বোঝা শিশুমনে প্রভাব ফেলছে, শারীরিক বাড়বৃদ্ধির ক্ষতি করছে। অতিরিক্ত ব্যাগের ওজন শিশুর ঘাড় এবং কাঁধের মাংসপেশির ক্ষতি করছে। অতীতের শিক্ষাব্যবস্থায় এ ভাবে শিশুদের শারীরিক ক্ষতি অন্তত হত না। প্রতিযোগিতা আগেও ছিল। কোথাও বেশি, কোথাও কম। কিন্তু তা এমন ভয়ঙ্কর স্তরের ছিল না। প্রতিযোগিতার মোহে এমন সমাজবিস্মৃতি ছিল না।
স্পষ্ট নীতি আর সদিচ্ছা
সময় এসেছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকরকে স্পষ্ট নীতি এবং সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। স্কুলব্যাগের ওজন কমাতেই হবে। কাগজেকলমে নয়, বাস্তবে। তবেই হয়তো শিক্ষার যান্ত্রিকিকরণ আটকানো সম্ভব হবে। কারণ, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ রাখার দায় আমাদের সকলের।
(লেখক শিলিগুড়ির বিধাননগর সন্তোষিণী বিদ্যাচক্র হাইস্কুলের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)