অন্তর্জলি!

একটি অপমৃত্যু সকলকে নির্বাক নিরুত্তর করিল, কিন্তু তাহা যে প্রশ্নগুলি উঠাইয়া দিয়া গেল, তাহার উত্তর কে দিবে? পিতামাতা কেন সন্তানকে চোখের আড়াল করিলেন, এই প্রশ্ন উঠিতেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৯ ০১:২৭
Share:

ক্ষতি বড় বেশিই হইয়া গিয়াছে!

গায়ক-কবির গানে হাহাকার ছিল: কত মানুষ মরিলে তবে স্বীকার করা হইবে, ক্ষতি বড় বেশিই হইয়া গিয়াছে! ইকো পার্কের জলাশয়ে চার বৎসর বয়সি শেখ আবেজের মৃত্যু নিষ্করুণ ভাবে গানটি মনে করাইয়া দিল। সংখ্যার প্রশ্ন ইহা নহে। একটিমাত্র মৃত্যুও বেদনাদায়ক। আবেজ শিশু বলিয়া, অলক্ষ্যে ঘটিয়া যাওয়া একটি দুর্ঘটনার দুর্ভাগ্যজনক শিকার বলিয়া যন্ত্রণা অধিকতর অনুভূত হইতেছে। সপ্তাহান্তের আনন্দঘন বিকালে ইকো পার্কে বেড়াইতে যাওয়া পিতামাতা সন্তানহারা হইলেন। চিলড্রেনস পার্ক সংলগ্ন ছোট জলাশয়টি শৈবালদলে সবুজ হইয়া ছিল, মাঠের সবুজ হইতে তাহার তফাত শিশুচক্ষু বুঝে নাই। আপনমনে খেলিতে খেলিতে শিশুটি সেইখানেই পড়িয়া ডুবিয়া যায়। যত ক্ষণে সকলের সংবিৎ ফিরিল, তাহার মধ্যে অনিবার্য অন্তিম ঘনাইয়া আসিয়াছে।

Advertisement

একটি অপমৃত্যু সকলকে নির্বাক নিরুত্তর করিল, কিন্তু তাহা যে প্রশ্নগুলি উঠাইয়া দিয়া গেল, তাহার উত্তর কে দিবে? পিতামাতা কেন সন্তানকে চোখের আড়াল করিলেন, এই প্রশ্ন উঠিতেছে। তাহা অপেক্ষাও জরুরি প্রশ্ন, শিশুদের পার্কের নিকটেই জলাশয় কেন? জলাশয় যদি বা থাকিবেই, তাহা জলজ পানা ও শৈবালমুক্ত নহে কেন? কেন তাহা দেখিয়া পার্শ্বের তৃণাচ্ছাদিত ভূমিরই অনুরূপ বলিয়া ভ্রম হইবে? স্থল ও জলভূমির সীমান্ত কেন নির্ধারিত থাকিবে না? যে বিস্তীর্ণ পার্কের ভিতরে ছোটবড় অনেকগুলি জলাশয় আছে, শতসহস্র মানুষ যেখানে চলিয়া-ফিরিয়া বেড়ান, পর্যাপ্ত নিরাপত্তারক্ষীর অনুপস্থিতি সেখানে বিপদাশঙ্কাকেই সূচিত করে। তাহা হইলে কি ইহাই বুঝাইয়া দেওয়া হইতেছে, অভিভাবকগণ নিজেদের ও শিশুদের দায়িত্ব লউন! দুর্ঘটনার অব্যবহিত পরেই জলাশয়ের সামনে জ্ঞাপিত হইয়াছে শিশুদের দূরে রাখিবার লিখিত সাবধানবাণী। অর্থাৎ ইঙ্গিতটি স্পষ্ট: পার্ক পুর-কর্তৃপক্ষের, কিন্তু পর্যটকের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার দায় প্রশাসনের নহে। ইহাতে শুধু জনসাধারণের প্রতি চরম অবিনয় ও উপেক্ষাই নিহিত নাই, জন-পরিষেবার ব্যবস্থাপনায় যে ন্যূনতম বোধবুদ্ধির প্রয়োজন হয়, তাহার অভাবও প্রতি পদে প্রকট। একটি শিশুর মৃত্যুর মূল্যে যখন পার্কের জলাশয় জালিকা দিয়া ঘিরিতে হয়, তখন বলিবার অপেক্ষা রাখে না, এই প্রশাসন চূড়ান্ত কাণ্ডজ্ঞানহীন ও অপদার্থ। তাহার প্রতি করুণাও অসঙ্গত, বরং এমত প্রশাসনের অধীন ও মুখাপেক্ষী যে বিপুল সংখ্যক মানুষ, তাঁহারাই হতভাগ্য অভাজন।

অথচ মহানগর উচ্ছল, পথে পথে বহুল-বিজ্ঞাপিত মহানাগরিক ও মুখ্যমন্ত্রীর ছবির মতোই হাস্যময়। শহর আলোকমালায় সাজাইতে এখন সন্ধ্যার অবকাশ বা উৎসবের উপলক্ষের দরকার পড়ে না। কোথায় জল জমিল, পানায় পূর্ণ জলাশয়ের বেষ্টনী আছে কি না, ডেঙ্গি-আক্রান্তের সংখ্যা পূর্বের বৎসরকে কত দূর ছাড়াইল, কোথায় কোন শিক্ষককুল কী কারণে আন্দোলন করিতেছেন, এই সকলই গৌণ। শীত আসিতেছে, নানাবিধ পার্বণ সমাসন্ন। ইকো পার্কে যখন সন্তানহারা মাতার ‘আহা রে’ বিলাপধ্বনি, তখন অদূরে খাদ্য-উৎসবে আহারে লালায়িত হওয়া সাজে কি না, সমাজমাধ্যমে উদ্যত অঙ্গুলি উঠিতেছে। ক্ষুব্ধ তর্জনের প্রশমনে সহমর্মিতা এই শাসকদিগের নিকট আশা করা বৃথা। শিশু শেখ আবেজ মরিয়া প্রমাণ করিল, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য-প্রশাসনও অন্তর্জলি যাত্রায় গিয়াছে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement