ফাইল চিত্র।
জাতীয় স্বচ্ছতা সর্বেক্ষণ সমীক্ষা ২০২০-র রিপোর্ট প্রকাশিত। দেশের ৪২৪২টি শহর অংশগ্রহণ করেছিল এই সমীক্ষায়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের কোনও শহর করেনি। কেন? এখানেও কি কেন্দ্র-রাজ্য দ্বন্দ্ব? না কি, এই রাজ্যে আবর্জনা ব্যবস্থাপনা যে অবস্থায় রয়েছে, তাতে অংশগ্রহণের চিন্তা বাতিল করতে হয়েছে? শেষের সম্ভাবনাটির পক্ষে যুক্তি আছে। এই সমীক্ষায় আবর্জনা-ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন ধাপে পুরসভাগুলির অগ্রগতিকে আলাদা করে মাপা হয়েছিল। আবর্জনা-সংগ্রহ এবং পরিবহণের জন্য ছিল ২৫%, প্রক্রিয়াকরণ এবং অবশিষ্ট আবর্জনার ব্যবস্থাগ্রহণের জন্য ৩৫%, ধারাবাহিক পরিচ্ছন্নতার জন্য ২৫%, সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ১০% এবং দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ৫% বরাদ্দ ছিল। এর দ্বিতীয় ধাপটিতে এসেই পশ্চিমবঙ্গের শহরগুলি বিপাকে পড়ত। কারণ, উত্তরপাড়া-কোতরং পুরসভা ছাড়া আর সবাই এই ধাপে এসে গোল্লা পেত। সংগ্রহ ও পরিবহণে কিছু কাজ হলেও, প্রক্রিয়াকরণ ও সংশ্লিষ্ট ধাপ এই রাজ্যে অনুপস্থিত। পরবর্তী ধাপগুলিতেও অগ্রগতি অস্পষ্ট।
অথচ, কলকাতায় দরজায় দরজায় আবর্জনা সংগ্রহ শুরু হয়েছিল ভারতের অন্য অনেক শহরের আগে। এখন তার পরিধি বেড়েছে, প্রযুক্তিগত উন্নতিও হয়েছে। এখন বেশ কিছু অঞ্চলে কমপ্যাক্টর মেশিন বসেছে। আবর্জনা আর রাস্তার মোড়ে খোলা জায়গায় জমা হচ্ছে না। খোলা গাড়ির পরিবর্তে বেশ কিছু আবর্জনা যাচ্ছে ঢাকা গাড়িতে। কিন্তু সবই শহরের প্রান্তে কোনও জায়গায় জমা হচ্ছে। যে সব পুরসভার দখলে আবর্জনা ফেলার মাঠ, অর্থাৎ ডাম্পিং গ্রাউন্ড আছে, তারা সেখানে ফেলছে। অন্যরা রাস্তার পাশে, নদীর পাড়ে, জলাভূমিতে ফেলছে। ফলে, পশ্চিমবঙ্গের মতো জনবহুল রাজ্যে জমির সঙ্কট, জলাশয় ও জলাভূমি ধ্বংস, নদী, খাল, কৃষিজমি এবং ভূগর্ভের জলে দূষণ বেড়েই চলেছে।
অথচ, ২০০০ সালের আবর্জনা ব্যবস্থাপনা বিধিতে বলা হয়েছিল, আবর্জনা উৎসে ভাগ করা বাধ্যতামূলক। ভিজে বা পচনশীল অংশ প্রক্রিয়াকরণ করে সার, জৈব গ্যাস ও বিদ্যুৎ উৎপাদন আর শুকনো নবীকরণযোগ্য আবর্জনা নির্দিষ্ট কারখানায় পাঠানোর কথা বলা হয়। যার নবীকরণ সম্ভব নয়, তাকে রাস্তা তৈরি বা জমি ভরাটের কাজে লাগানো হবে। অবশিষ্ট আবর্জনা যাবে ‘স্যানিটারি ল্যান্ডফিল’-এ।
এই আইন তৈরির ২০ বছর পরে আমরা কোথায় আছি? গোড়াতেই আলাদা করে জৈব আবর্জনার যথাযথ প্রক্রিয়াকরণ এবং নবীকরণযোগ্য আবর্জনা পরিষ্কার অবস্থায় কারখানায় পাঠানোর ব্যবস্থা চালু করা যায়নি। কলকাতা, চন্দননগর, ভদ্রেশ্বর এবং পানিহাটির মতো কয়েকটি পুর কর্পোরেশন এবং পুরসভা এলাকায় নিয়মিত জৈব সার তৈরির পরিকাঠামো গড়ে উঠেছিল। এখন সবই আবর্জনা ফেলার ভাগাড়ে পরিণত। একমাত্র উত্তরপাড়া-কোতরং পুরসভায় আবর্জনা থেকে সার তৈরির কারখানাটি চালু রয়েছে। যেখানে গোড়াতেই আবর্জনাকে ভাগ করে সংগ্রহ করার ব্যবস্থার কথা শোনা যায় এবং পুরসভার উদ্যোগে বাড়িতে বাড়িতে দু’রঙের পাত্রও বিলি করা হয়, সেখানেও সেই ভাগ করা আবর্জনা আবার মাঠে নিয়ে গিয়ে মিশিয়ে ফেলা হয়। ফলে, সাধারণ মানুষ এবং পুরকর্মীরা উৎসাহ হারান। ধাপায় মিথেন সংগ্রহ প্রকল্প, হুগলিতে যৌথ প্রক্রিয়াকরণ প্রকল্প ইত্যাদি কয়েকটি বৃহৎ প্রকল্পের কথা জানা গেলেও সাধারণ চিত্র তাতে বদলায় না। জনবহুল পঞ্চায়েতগুলির অবস্থাও একই রকম।
২০১৬-র ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট রুলস-এ বলা হয়েছে আবর্জনা কুড়ানি বা সংগ্রাহকদের আবর্জনা ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। শুকনো আবর্জনা সরাসরি তাঁদের কাছে পৌঁছতে হবে। শুকনো আবর্জনা রিসাইকল করা বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এর জন্য কুড়ানি এবং সংগ্রাহকদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে দেওয়া, পরিচয়পত্র, সামাজিক সুরক্ষা দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। বাড়িতে আলাদা করে রাখা শুকনো আবর্জনা কুড়ানিরা সরাসরি বাড়ি থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে গেলে সেগুলি পরিষ্কার থাকে, রিসাইক্লিং করতে সুবিধা হয়, পুরসভার পরিবহণ খরচ কমে, দৃশ্যদূষণ বন্ধ হয় এবং স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা কমে। একই সঙ্গে, ভিজে আবর্জনাও ‘বিশুদ্ধ’ থাকে, তা প্রক্রিয়াকরণ করতে সুবিধা হয়। কিন্তু আমাদের রাজ্যে গোটা ব্যবস্থাটাই বিপরীতমুখী।