বকেয়া সংস্কারের হিসাব কষিতে বসিলে ভারতে কৃষিক্ষেত্রের তুলনা নাই। অন্য ক্ষেত্রগুলিতে এক পা দুই পা করিয়া সংস্কার যদি বা অগ্রসর হয়, কৃষিক্ষেত্রে তাহা স্থাণুবৎ। অতএব, কোভিড-১৯ সংক্রান্ত আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করিবার অবকাশেই অর্থমন্ত্রী যদি কৃষি সংস্কারের কথা বলেন, তবে তাহার স্থান-কাল হইয়া কিঞ্চিৎ বিস্ময় জাগে বটে, কিন্তু তাহাতে এই সংস্কারের গুরুত্ব ঢাকা পড়ে না। অর্থমন্ত্রী জানাইয়াছেন, এসেনশিয়াল কমোডিটিজ় অ্যাক্ট বিলোপ করা হইল; এবং এপিএমসি আইনেও সংস্কার করিয়া ব্যবস্থা হইল, অতঃপর যে কেহ কৃষকের নিকট ফসল কিনিতে পারিবেন, তাহার জন্য কোনও লাইসেন্সের প্রয়োজন হইবে না। সিদ্ধান্ত দুইটিকে তাহাদের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা বিধেয়। অত্যাবশ্যক পণ্য আইনটি ১৯৫৫ সালের— প্রাক্-সবুজ বিপ্লব পর্বের। সেই আমলের ভারতে খাদ্যপণ্যের অভাব ছিল প্রকট বাস্তব, এবং সেই অভাবকে ব্যবহার করিয়া কালোবাজারির রমরমা হইয়াছিল। সেই দুষ্টচক্র ভাঙিতে অত্যাবশ্যক পণ্য আইনের গুরুত্ব ছিল। ২০২০ সালের ভারতে অভাব নাই, প্রাচুর্য রহিয়াছে। ফলে, অত্যাবশ্যক পণ্য আইনও তাহার তাৎপর্য হারাইয়াছে। আইনটি বিলুপ্ত হইলে কৃষকের নিকট বাজারের পরিধি বাড়িবে, ফলে তাহাদের আয়-সম্ভাবনাও বাড়িবে। অন্য দিকে, কৃষিপণ্য খরিদের ক্ষেত্রে এপিএমসি লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করিবার অর্থ, কৃষিতে মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির প্রাধান্যও বজায় রাখা। তাহা কৃষকের স্বার্থের অনুকূল নহে। ব্যবস্থাটি বাতিল হইবার ফলে সর্বাধিক মূল্যে পণ্য কিনিতে আগ্রহীর নিকটই ফসল বেচা সম্ভব হইবে। সংস্কার কথাটির অর্থ বাজারকে যথাসম্ভব কাজ করিতে দেওয়া। ক্রেতার একচেটিয়া অধিকার ভাঙিয়া দেওয়া তাহার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
এক্ষণে দুইটি প্রশ্ন উঠিবে। এক, কৃষকের স্বার্থরক্ষা করিতে এই সংস্কারগুলি কি যথেষ্ট, না কি আরও কিছুর প্রয়োজন? এবং দুই, এই সংস্কার কি কোভিড-১৯ বিধ্বস্ত অর্থব্যবস্থাকে উদ্ধার করিতে স্বল্পমেয়াদে কার্যকরী হইবে? দুর্ভাগ্যক্রমে, দুইটি প্রশ্নের উত্তরই নেতিবাচক। কৃষির বাজারের অভিজ্ঞতা বলিতেছে, কৃষক ঋণের ভারে এমনই জর্জরিত যে ফসল উঠিবার সঙ্গে সঙ্গে, এমনকি ফসল উঠিবার পূর্বেই, তাহাকে বেচিয়া দেওয়া ভিন্ন তাঁহাদের আর উপায় থাকে না। ফলে, আন্তঃরাজ্য বাণিজ্যের পথ খুলিলেই বা কী, সর্বোচ্চ দাম দিতে ইচ্ছুক ক্রেতার নিকট পণ্য বেচিবার অধিকার মিলিলেই বা কী— তাহার অপেক্ষায় থাকিবার সুযোগ কৃষকের নাই। ফলে, বিশেষত ছোট কৃষককে যদি বাজারের সুবিধার অংশী করিতে হয়, সর্বাগ্রে তাহার জন্য সুলভ প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ব্যবস্থা করিতে হইবে। অর্থমন্ত্রীর ঘোষণায় ঋণের প্রসঙ্গ আছে বটে, কিন্তু সেই ঋণ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের নিকট পৌঁছাইবার রূপরেখাটি এখনও অজ্ঞাত। দ্বিতীয়ত, সংস্কারের এই সিদ্ধান্তগুলি স্বল্পমেয়াদে যথেষ্ট কার্যকর না হইবারই সম্ভাবনা। কৃষিপণ্যের যথেষ্ট দাম না পাওয়া কৃষকের দীর্ঘকালীন ও স্থায়ী সমস্যা। কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁহাদের ভাবিতে হইতেছে অন্য অনেকগুলি বিষয় লইয়া। খারিফ শস্যের চাষ আরম্ভ করিবার পূর্বে তাঁহাদের বীজ প্রয়োজন, কৃষি উপকরণ প্রয়োজন, প্রাথমিক স্তরের ঔষধ প্রয়োজন। বাজার অচল থাকায় কোনওটিই তাঁহাদের আয়ত্তে নাই। অন্য দিকে, পরিবহণ ব্যবস্থা কার্যত ভাঙিয়া পড়ায় রবি মরশুমের উৎপন্ন ফসলও অনেকে ন্যায্য দামে বিক্রয় করিতে পারেন নাই। ক্যাশক্রপ বা বাণিজ্যিক ফসলের ক্ষেত্রে বাজারের চাহিদার অভাব বড় সমস্যার কারণ হইয়াছে। কোভিড-১৯ সংক্রান্ত আর্থিক প্যাকেজে এই প্রসঙ্গগুলির উল্লেখ থাকা জরুরি ছিল। নচেৎ সন্দেহ হইবে যে প্যাকেজ অজুহাতমাত্র, উদ্দেশ্য শুধু এই সংস্কার-সিদ্ধান্তগুলি চালু করিবারই ছিল।