২৬ মে। ঠিক এই দিনটিতে নরেন্দ্র মোদী রাষ্ট্রপতি ভবনে শপথগ্রহণ করেছিলেন। অতএব, আজ এ লেখা যখন লিখছি মোদী সরকারের তখন একটি বছর পূর্ণ হল। রাজধানীতে বসে এ সপ্তাহে প্রকাশিত যতগুলি পত্রপত্রিকা দেখেছি, কার্যত প্রতিটি সংবাদমাধ্যমে মোদী সরকারের সমালোচনা। ভাল কাজ কিছু হয়েছে, কিন্তু না হওয়ার মোহভঙ্গের তালিকাটি অনেক বেশি দীর্ঘ। অনেকেই বলছেন, খুব অল্প সময়ে শাসক দল মানুষের প্রবল প্রত্যাশায় বড় জোরে আঘাত দিয়েছে। স্বভাবতই, শাসককুল এ কথা স্বীকার করতে রাজি নন। কিন্তু খুব স্পষ্ট, সাধারণ ভাবে জনমানসে এই ধারণাই প্রবল হয়েছে যে মোদী সরকার ‘অচ্ছে দিন’ নিয়ে আসার কাজে ব্যর্থ হচ্ছে।
কেন এমন হচ্ছে?
ক’দিন আগে এবিপি নিউজে সরকারের বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক সভায় এসেছিলেন বিজেপি-র সভাপতি অমিত শাহ। তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, এক বছর পুর্ণ হওয়ার লগ্নে কেন এই ধারণাই সংবাদমাধ্যমে সাধারণ ভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে যে, এ সরকার প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে? জবাবে অমিত শাহ অবশ্য প্রকাশ্যে সংবাদমাধ্যমকেই দোষী সাব্যস্ত করেননি। কিন্তু, তিনি এ কথা স্বীকার করেছেন যে সংবাদমাধ্যমে গত এক বছরের বহু ভাল কাজই সুষ্ঠু ভাবে প্রতিফলিত হয়নি। একে বলা যায়, ‘পলিটিক্স অফ পারসেপশন’। অমিত শাহ বলেন, ‘‘সংবাদমাধ্যমের কাছে আমাদের ভাল কাজগুলি সুষ্ঠু ভাবে বোঝাতে আমরা সফল হইনি। বর্ষপূর্তির সময় এই বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখব।’’
আমি তিরিশ বছরের অধিক সময় সাংবাদিকতা করছি এবং তার মধ্যে সাতাশ বছরেরও বেশি দিল্লিতে আছি। বিজেপি নামক দলটিকে দেখছি যখন এ দলের সাংসদ সংখ্যা ছিল দুই। দুই থেকে কী ভাবে এই দলটি দু’শোতে পৌঁছল তা-ও দেখেছি খুব কাছ থেকে। কিন্তু এটাও সত্য নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে এই প্রথম বিজেপি একক ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করল।
কিন্তু সংবাদমাধ্যমে ভাল কাজ প্রতিফলিত হচ্ছে না, এই যে সবাই মিলে হঠাৎ রে-রে করে উঠে সরকারি ঢক্কানিনাদ শুরু করে দিয়েছে, তাতেই কি মোক্ষলাভ হবে? কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সাংবাদিক বৈঠক করুন। সংবাদমাধ্যমকে জানান, কত মহান কাজ করা হয়েছে গত এক বছরে। বিজ্ঞাপন আরও বাড়ছে, সরকারি বক্তব্য তুলে ধরা হচ্ছে, সাংবাদিককুলকে ডেকে বোঝানো হচ্ছে। জনসংযোগ সংস্থাদের ফের কাজে লাগান হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়াকে মনিটরিং করা হচ্ছে।
আজকাল গণজ্ঞাপন মাধ্যমে অনেক পরিভাষা। মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট, স্টোরি মনিটরিং ও স্টোরি ম্যানেজমেন্ট, হেডলাইন ম্যানেজমেন্ট। ঘুম থেকে উঠেই সাতসকালে রাজনৈতিক নেতারা আগে টেলিভিশনে ‘বাইট’ দিতেন না। এখন দিতে হচ্ছে। কারণ শ’য়ে শ’য়ে টিভি চ্যানেল। ইংরেজি, হিন্দি ও আঞ্চলিক ভাষায়। অতএব, এই সব চ্যানেলে সাতসকালে কোনও একটি বিষয়ে যে আগে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন তাঁর বক্তব্যই সকাল থেকে প্রচারিত হতে থাকবে। একে বলা হয়, ‘নিউজ হুইল ম্যানেজমেন্ট’। এখন সব দলই এই কাজটিতে নেমে পড়েছে। চ্যানেলগুলিতে সন্ধ্যাবেলায় বিতর্কসভা শুরু হলে তার উপরও নজর রাখতে হবে সেখানে কী আলোচনা হচ্ছে? হেডলাইন বা শিরোনামে কী? এ সব নিয়েও সম্পাদকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা প্রয়োজন।
সংবাদমাধ্যম এ দেশে বেশির ভাগটাই বেসরকারি। এই বেসরকারি সংস্থাগুলির সঙ্গে কথোপকথন সর্বদাই ভাল। সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ। চিন বা সিঙ্গাপুরে তো বেসরকারি সংবাদমাধ্যম বলে বাস্তবে কিছু নেই। সিঙ্গাপুরে সবটাই কাগজে-কলমে স্বাধীন বেসরকারি, কিন্তু সংবিধানে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই। তাই ওখানকার খবরের কাগজগুলো খুব নীরস। আবার চিনে সবটাই সর্বহারার একনায়কতন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম। অধুনা অনেক সংবাদ সংস্থা নামে বেসরকারি হচ্ছে, কিন্তু সেগুলিতে কর্পোরেটাইজেশন হলেও মালিকানা পার্টির নিয়ন্ত্রণে। সে তুলনায় আমরা, ভারতীয় সাংবাদিকরা আজও অনেক স্বাধীন। এ দেশে এক বারই জরুরি অবস্থা এসেছিল। সেটাও হয়েছিল ইন্দিরা গাঁধীর জমানায়। তবু এ দেশে স্বাধীন জনমত এখনও শক্তিশালী। জগন্নাথ মিশ্র বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রেস নিয়ন্ত্রণ বিল এনে বিপদে পড়েছিলেন। আবার রাজীব গাঁধীকে সংসদে এসে প্রেস বিল প্রত্যাহার করতে হয়েছিল।
আমার মনে হয়, রাজনেতারা সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করে যদি জনমতকে গুরুত্ব দেন তবে তা এ সমাজের জন্য কাঙ্খিত। অনেকে বলেন, রাষ্ট্রনেতার যদি শক্তিশালী দায়বদ্ধতা থাকে, যদি জনকল্যাণকামী সুষ্ঠু দৃষ্টিভঙ্গি থাকে তবে সমাজে নতুন কিছু করতে গিয়ে জনমতের জনপ্রিয় বাধা আসতে পারে, কিন্তু পরে সমাজ তা বুঝতে পারে। ইন্দিরা গাঁধীর ব্যক্তিগত মালিকানা বা রাজন্যভাতার উচ্ছেদ, অথবা নরসিংহ রাওয়ের আর্থিক উদারবাদ সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বোঝেনি, কিন্তু পরে তা বুঝতে পেরেছিল। জমিবিলের মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদী যদি মানুষের ভালই করতে চান তবে আগামী চার বছরে তার প্রমাণও তাঁকেই রাখতে হবে।
নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্ব শক্তিশালী বলেই প্রচারিত। যাকে বলা হয় ‘স্ট্রং লিডারশিপ’। কিন্তু শক্তিশালী নেতৃত্ব শুধুমাত্র দলের অর্জিত সাংসদ সংখ্যা দিয়ে নিরূপিত হয় না, সেই ব্যক্তির সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার স্বৈরতন্ত্রী প্রবণতা দিয়েও শক্তিশালী নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠা হয় না, শক্তিশালী নেতৃত্ব কোনও ‘ক্লোন’ নয়। কৃত্রিম ভাবে সংবাদমাধ্যমের বিজ্ঞাপন— ছবি দিয়ে নেতৃত্বের নির্মাণও হয় না বিনির্মাণও হয় না। নেতৃত্বের শক্তির বিকাশ হয় আপনা থেকেই। এর মধ্যে এক ধরনের স্বতস্ফূর্ততা থাকে। মোদী যে নেতা হয়েছেন সেটা সংবাদমাধ্যমেরই নির্মাণ এ কথা যাঁরা বলেন তাঁদের সঙ্গেও সে দিন আমি একমত হইনি। আজও মোদীর জনপ্রিয়তা যদি কমতে থাকে তবে সেটার জন্যও ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ বলে সংবাদমাধ্যমকেই একক ভাবে দোষ দেওয়া অনুচিত।
‘কেষ্টা বেটাই চোর’— রাজনেতারা মিডিয়া সম্পর্কে চিরকাল এই মনোভাব নিয়েছেন। কিন্তু সংবাদমাধ্যম আসলে অনুঘটক বা ক্যাটালিস্টের ভূমিকা পালন করতে পারে মাত্র। যাঁর পতন হচ্ছে, প্রচার তাঁর পতনকে ত্বরান্বিত করতে পারে, যাঁর জনপ্রিয়তা ঊর্ধ্বমুখী তাঁকে টেনে নামানো যায় না। তাঁকে ধাক্কা দিয়ে আরও একটু দ্রুত তুলতে সাহায্য করতে পারে। তাই ‘ল অফ নেচার’ বা প্রাকৃতিক মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে গিয়ে পতনোন্মুখ আপেলটিকে উপরে তোলা যায় না। ভক্তবৃন্দ যতই বলুন না কেন, কিং ক্যানিউট-ও বুঝতে পেরেছিলেন ঢেউ পিছন দিকে যেতে পারে না, রাজা যতই তাঁকে আদেশ দিন না কেন।
তাই বর্ষপূর্তির লগ্নে মোদীর সরকার সংবাদমাধ্যমের ঘাড়ে দোষ না চাপিয়ে বরং আত্মানুসন্ধান করুন। ত্রুটিগুলি শুধরে সামনের দিকে এগোতে পারেন মোদী। কৃত্রিম পদ্ধতিতে ‘ক্লোন’-এর মতো নয়, স্বতস্ফূর্ত স্বাভাবিক এক জনকল্যাণকামী রাজনেতার ‘পথ’ ধরে।