বীতশ্রদ্ধ: বিশ্বভারতীতে নাগরিকত্ব আইনের পক্ষে বক্তৃতার সময়ে গেটের বাইরে প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীর ভিড়, শান্তিনিকেতন, ৮ জানুয়ারি
বিশ্বভারতী বক্তৃতামালার অধিবেশন শেষ হয়েছে। চলছে গান, ‘প্রাণের সঙ্গে প্রাণে সে যে মিলিয়েছে এক তানে, মোদের ভাইয়ের সঙ্গে ভাইকে সে যে করেছে এক মন, আমাদের শান্তিনিকেতন।’ ঘরের জানালার কাচের ওপর তখন বাইরে থেকে ধাক্কা দিচ্ছে অনেকগুলো হাত, স্লোগান উঠছে, ‘স্বপন দাশগুপ্ত গো ব্যাক, উপাচার্য ছি ছি।’ ভবনের দুটো গেটই তালাবন্ধ, বাইরের লোক যাতে ঢুকতে না পারে। গেটের ও দিকে আরও দুর্ভেদ্য দেওয়াল তৈরি করেছে ছাত্রছাত্রীরা, নিজেদের দেহ দিয়ে। ভিতরের লোক যাতে বেরোতে না পারে। নাগরিকত্ব আইন দেশের মধ্যে তৈরি করছে নতুন নতুন সীমান্ত। ‘এক প্রাণ, এক মন’ কথাগুলো তার কাঁটাতারে গেঁথে ঝুলছে, ছেঁড়া কাপড়ের টুকরোর মতো। ৮ জানুয়ারি ঘেরাও উঠেছিল রাত ন’টা পার করে।
অথচ ব্যতিক্রম হওয়ার কথা ছিল বিশ্বভারতীর। যাদবপুর বা জেএনইউয়ের মতো উত্তাল ছাত্র আন্দোলন নেই এখানে। প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব একটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল আছে, যা পরিচিতি-নির্বিশেষে যোগ দেওয়ার সুযোগ দেয়। শিক্ষকদের বড় অংশ আবাসিক। প্রতিবাদও হয়, কিন্তু মিছিল শেষে মোমবাতি সার দিয়ে জ্বলে ছাতিমতলায়। এমন প্রতিষ্ঠানের উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী ঘোষণা করেন, নাগরিকত্ব আইন নিয়ে আলোচনা হবে। অন্য ক্যাম্পাসে যখন পুলিশ-ছাত্র সংঘাতের মধ্যে ত্রিশঙ্কু প্রশাসন, তখন এমন আহ্বান ব্যতিক্রমী বইকি।
কাজের বেলা দেখা গেল, আইনের সমর্থকেরা সব ঘরের ভিতরে, আর বিরোধীরা বাইরে। লাল পতাকা, কালো পতাকা জানালা দিয়ে ঢুকে আসছে ভিতরে, চিৎকৃত ধিক্কার ডুবিয়ে দিতে চাইছে কথাকে। উপাচার্য বললেন, ‘‘বাইরে মিউজ়িক চলছে।’’ কিন্তু কেন? ওদের ভিতরে ডাকলেই তো হত। মতের সংঘাতই তো বিতর্ক। উপাচার্যের উত্তর, তিনি সিএএ-বিরোধী শিক্ষকদের ডেকেছিলেন, তাঁরা আসেননি। তাঁর গলায় অভিযোগ। শুনলে কিন্তু উদ্বেগই জাগে বেশি। বিতর্কের আহ্বান
যাঁরা খারিজ করেন, তাঁরা কেমন অধ্যাপক? যিনি বিরুদ্ধ মতকে মঞ্চে আনতে ব্যর্থ, তিনি কেমন উপাচার্য? কয়েকশো পড়ুয়াকে বাইরে রাখতে গেট আটকে বক্তৃতার আয়োজন করা হয় যেখানে, তা কেমন বিশ্ববিদ্যালয়?
নাগরিকত্ব আইন নিয়ে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে যে ঝড় উঠেছে, তা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’-এর ধারণাটাকেই। পঠন-পাঠন যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রধান স্তম্ভ হয়, তবে তার অপর স্তম্ভ তার স্বাতন্ত্র্য। দলীয় রাজনীতির ইঁদুর দীর্ঘ দিন ধরেই তাকে ফোঁপরা করছে। কী তার দশা, তা দেখা যাচ্ছে এ বার, যখন স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র আন্দোলনের মুখে ভেঙেচুরে এক হয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সরকার আর পুলিশ। জেএনইউ-এ যে ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়ুয়াদের পেটাতে পারে বহিরাগতেরা, তার পরে উপাচার্য আক্রান্তদের নামেই পুলিশে অভিযোগ লেখান। এ কেবল চামচাগিরি নয়। প্রতিষ্ঠানে ধস নামা।
বিশ্বভারতীতে দেখা গেল, সিএএ নিয়ে অনুষ্ঠানের স্থান বদল হল শেষ মুহূর্তে, সম্ভবত বিক্ষোভ এড়াতে। সে বার্তা না পেয়ে ‘লিপিকা’ থেকে ফিরে গেলেন অনেক ছাত্র এবং শিক্ষক, কিন্তু যথাস্থানে, যথাসময়ে এলেন দুধকুমার মণ্ডল, রামপ্রসাদ দাস-সহ অনেক বিজেপি নেতা-কর্মীরা। বিমর্ষ লাগে যখন অনুষ্ঠানের চার বক্তার (দু’জন বাইরের, দু’জন বিশ্বভারতীর) কেউ সিএএ-র বিরুদ্ধে একটি যুক্তিও দেন না। মূল বক্তা বিজেপি সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত বললেন, যাঁরা রবীন্দ্রনাথের ‘এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু-মুসলমান’ মনে করাচ্ছেন তাঁরা আসলে নির্বিচার নাগরিকত্বের পক্ষে সওয়াল করছেন— এবং এক জন ছাত্র-শিক্ষকও প্রতিবাদ করলেন না। আরও দেখা গেল, বক্তৃতার পর এক তরুণ স্বপনবাবুকে গিয়ে বলছেন, ‘‘স্যর, এ বার জন্মনিয়ন্ত্রণ আইনটা করুন।’’
বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অবনমন অনুভব করতে পারছেন ছাত্রেরাও। স্বরাজ পার্টির নেতা যোগেন্দ্র যাদব মনে করেন, সেই জন্যই যাদবপুর, জেএনইউ, আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি, এমন কিছু পরিচিত ‘ট্রাবল্ স্পট’ পেরিয়ে এ বার ছাত্র আন্দোলন ছড়িয়েছে আইআইটি-আইআইএম থেকে শুরু করে ছোট ছোট শহরের বিশ্ববিদ্যালয় অবধি। এ কেবল পুলিশের অত্যাচার, এমনকি নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতাও নয়। যে ধরনের আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন এখন চলছে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, যা ছাত্রদের সামনে পড়াশোনায় উৎকর্ষ, ভাল কাজের সুযোগ, কোনও দরজাই খুলে দিতে পারে না, অথচ লাইব্রেরিতে কাজের সময়, মেয়েদের হস্টেলে ঢোকার সময় বেঁধে দিয়ে ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করতে চায়— তার প্রতি বীতশ্রদ্ধ তরুণ-তরুণীরা। ‘‘আজ যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় চালাচ্ছেন, তাঁদের ধীশক্তি, চিন্তাশীলতার প্রতি ছাত্রদের আস্থা নেই। উপাচার্যকে নিয়ে ছাত্রেরা হাসাহাসি করে।’’ এ রাজ্যের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তৃণমূল ছাত্র পরিষদের ধর্নামঞ্চে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কোল ঘেঁষে বসেছিলেন। ছবি বেরোল, তাঁরা হাসছেন। ভাগ্যিস, ছাত্রদের হাসির ছবিগুলো ওঠেনি।
অশ্রদ্ধা থেকে অনাস্থা। কখনও দাবি ওঠে, উপাচার্যকে ক্ষমা চাইতে হবে। কখনও দাবি, ইস্তফা দিতে হবে। কেন এমন ফাঁক তৈরি হচ্ছে প্রশাসনের সঙ্গে ছাত্রদের? আমদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পঙ্কজ চন্দ্র লিখছেন, ‘‘যাঁরা প্রশাসনে আসছেন, তাঁরা যে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার মূল কারণগুলি সম্পর্কে অবহিত, এবং উৎকর্ষ অর্জনের প্রতি উদ্বুদ্ধ, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া চাই। না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা আমাদের শ্রমলব্ধ বর্তমান দিয়ে যেতে পারব না।’’ যাঁদের সে ক্ষমতা নেই, সেই প্রশাসকেরা ‘বিষাক্ত’, তাঁদের সরানো দরকার, বলছেন পঙ্কজ। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় অতীত আর ভবিষ্যতের মধ্যে সেতু বাঁধে। ‘‘আমরা সকলেই ইতিহাসের অন্তহীন প্রগতির অংশ, এই বোধটা তৈরি করা চাই। প্রতি প্রজন্মের শিক্ষক-ছাত্র তার পূর্বের প্রজন্মের আবিষ্কার থেকে গ্রহণ করেন।
যাঁরা তা করেন না, তাঁরা প্রগতির ধারাকে বিচ্ছিন্ন করেন, উন্নয়ন ব্যাহত হয়’’ (বিল্ডিং ইউনিভার্সিটিজ় দ্যাট ম্যাটার)।
এই উন্নয়ন কেবল ছাত্র-শিক্ষক বা প্রতিষ্ঠানের নয়। সমাজের, দেশের। তার এক দিক অবশ্যই অর্থনৈতিক সম্পদ বৃদ্ধি, কিন্তু অপর দিক সামাজিক সম্পদের সমৃদ্ধি। মানুষে-মানুষে মতের বিরোধ সত্ত্বেও পরস্পরের প্রতি যা আস্থা ধরে রাখার শক্তি রাখে। রবীন্দ্রনাথ আর মহাত্মা গাঁধী, যাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ শান্তিনিকেতনে ১৯১৪ সালে, সারা জীবন কম তর্ক করেননি। সম্মুখ সংলাপে, চিঠিতে, নিবন্ধে তাঁদের তীব্র মতানৈক্য যে সব যুক্তি তুলে এনেছিল, আজও উন্নয়নের মৌলিক বিতর্কগুলি দাঁড়িয়ে সে সবের উপর। ১৯৩৮ সালে শান্তিনিকেতনেই মেঘনাদ সাহা হিন্দু ধর্মের অসহিষ্ণুতা, প্রযুক্তি-বিমুখতাকে আক্রমণ করে বক্তৃতা করেন। ‘ভারতবর্ষ’-এর পাতায় তা নিয়ে বিতর্ক ওঠে, যার সূত্রে তাঁর সেই বিখ্যাত ‘সব ব্যাদে আছে’ বিদ্রুপোক্তি। ধর্মাভিমানীর সঙ্গে বিজ্ঞানমনস্কতার এই সংঘাতও আমাদের উত্তরাধিকার। এমন কত না সম্পদ বিশ্ববিদ্যালয়ের। যাঁরা উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত, তাঁরাও ওয়ারিশ। এই তো প্রগতির ধারা।
আজ কেন তা বিচ্ছিন্ন হচ্ছে? কেন বিপক্ষের স্থান হচ্ছে আলোচনা সভার বাইরে? রাত ন’টা, প্রবল শীত, গুঁড়িগুঁড়ি হিমশীতল বৃষ্টি, ক্যাম্পাসের গেট আটকে দাঁড়িয়ে ছেলেমেয়েরা। ‘‘সাংবাদিক হন আর যা-ই হন, বেরোতে দেব না।’’ কেন, বক্তৃতা শুনলে দোষ কী? ‘‘যে কারও কথা আপনি শুনবেন?’’ সে কী, যার সঙ্গে মতে মেলে না, তার কথা তো বেশি করে শোনা দরকার! ছিলে-টানা শরীরগুলো থমকে গেল। ‘‘এই, এঁকে যেতে দে।’’ এই তরুণদের সঙ্গে কথা বলা না কি খুব কঠিন? সত্যি? জানালার ফাঁক দিয়ে কিছু শিক্ষক এই পড়ুয়াদের ছবি তুলছিলেন মোবাইলে। তাতে এদের কতটুকু ধরা গেল?
গেট দিয়ে বার করেই পিছু ডাক, ‘‘দিদি, আপনি কিন্তু সত্যিটা লিখবেন। আমরা কোনও দলের নই, আমরা স্টুডেন্ট। সাংসদ টুইট করেছেন, আমরা ঢিল ছুড়েছি। আপনি তো দেখলেন, আমরা স্টোন-থ্রোয়িং করিনি। উনি মিথ্যে বলছেন।’’ এদের থেকে নিরাপত্তা পেতে উপাচার্য ভবনের গেটে তালা দিয়েছেন, আর এরা উপাচার্যকে এদের বিরোধিতা বোঝাতে তালা দিয়েছে ক্যাম্পাসে ঢোকার গেটে।
আটকে রয়েছে ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়।