বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে একের পর এক বাড়ি। ছবি: রয়টার্স।
কয়েক দিন ধরে ছবিগুলো দেখছি আর চমকে চমকে উঠছি! বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে একের পর এক বাড়ি। আইনের শাসনকে লবডঙ্কা দেখিয়ে এ কাজ করা হচ্ছে আমাদেরই এই দেশে। হায় রে গণতন্ত্র!
ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আবার দেখলাম টুইট করেছেন, কড়া শাস্তি দিতে এক অভিযুক্তের বাড়ি ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি, ভাঙচুরের ঘটনার ভিডিয়োও তিনি জুড়ে দিয়েছেন টুইটারে। উত্তরপ্রদেশে একাধিক ব্যক্তির বাড়িঘর ধূলিসাৎ করে বলা হচ্ছে, সব ‘বেআইনি নির্মাণ’। ঘটনাচক্র বলছে, যাঁদের বাড়ি ভাঙা হল সে রাজ্যে, তাঁরা সকলেই মুসলমান। এবং তাঁরা অংশ নিয়েছিলেন বিজেপির প্রাক্তন মুখপাত্র নূপুর শর্মার বিতর্কিত মন্তব্যের বিরুদ্ধে সংগঠিত বিক্ষোভে। এ সব দেখেশুনে প্রশ্ন জাগছে, দেশ থেকে কি আইনের শাসন উধাও হয়ে গেল? আদালতের বিচার প্রক্রিয়া ছাড়া সরকার বা প্রশাসনই কি এ ভাবে এ বার থেকে শাস্তি দেবে!
আসলে সবটাই পরিকল্পিত। বলা ভাল, পরিকল্পিত গুন্ডামি। এ পর্বের শুরুটা হয়েছিল মে মাসের শুরুতে। জ্ঞানবাপী মসজিদে অন্য কোনও ধর্মের নিদর্শন আছে কি না জানতে সেখানে সমীক্ষা ও ভিডিয়োগ্রাফির নির্দেশ দিয়েছিল বারাণসী দায়রা আদালত। আদালতের নির্দেশ মেনে সে কাজ শুরু হতেই বিতর্ক তৈরি হয়। সেই বিতর্কটাকেই গোটা দেশ জুড়ে পরিকল্পিত ভাবে ছড়িয়ে দিল বিজেপি। একটা গন্ডগোলের সূত্রপাত হল। সেই গন্ডগোলকে সামনে রেখেই নূপুর মহাবিতর্কিত মন্তব্য করে বসলেন। না, না ভুল। করে বসলেন নয়, নূপুরকে দিয়ে করানো হল। এই নূপুরই একটা সময় অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের সভানেত্রী ছিলেন দিল্লিতে। অরবিন্দ কেজরীবালের বিরুদ্ধে ভোটেও দাঁড়িয়েছিলেন। সেই নূপুরকে দিয়েই করানো হল অন্য ধর্মের মানুষজনকে আঘাত করা এক জঘন্য মন্তব্য। পরিকল্পিত। অবশ্যই পরিকল্পিত।
কড়া শাস্তি দিতে এক অভিযুক্তের বাড়ি ভেঙে দেওয়া হচ্ছে।
কেন এই পরিকল্পনার প্রয়োজন পড়ল? কারণ, এই মুহূর্তে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা প্রবল সঙ্কটে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তো বটেই, গ্যাস বা জ্বালানির দাম যে জায়গায় গিয়েছে, তাতে সাধারণ মানুষের নাজেহাল দশা। দেশ জুড়েই। কোথাও কেউই স্বস্তিতে নেই। এ রকম একটা সময়েই তো সকলের মুখ ঘোরাতে হয়। পরিকল্পনা করেই বিজেপি দেশবাসীর মুখ ঘোরাতে চেয়েছে। পেরেওছে।
সব কিন্তু ওই একটা পরিকল্পনারই অংশ। আর সেই পরিকল্পনায় প্রধান তুরুপের তাস হিসাবে বিজেপি বেছে নিয়েছে ধর্মকে। কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, ধর্ম হল জনগণের আফিম। আমরা ভারতীয়েরা ভাবতাম, মার্ক্সের ও সব তত্ত্ব এ দেশে অন্তত খাটে না। কিন্তু আমরা ভুল ছিলাম। মার্ক্সের সেই ব্যাখ্যাকেই ফলিত স্তরে কাজে লাগাচ্ছে বিজেপি। এ দেশে তারা তো ধর্মটাকে প্রায় একমাত্রিক করে ফেলেছে। ভারতে ধর্মের যে বহুমাত্রিক ছটা ছিল, তাকে স্তিমিত করে দিয়েছে বিজেপি। ধর্মের আফিমে বুঁদ করে দিয়ে দেশবাসীকে সব কিছু থেকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে চায় তারা।
আদালতের নির্দেশে জ্ঞানবাপীতে সমীক্ষা ও ভিডিয়োগ্রাফির নির্দেশের পর তাই নূপুরকে মঞ্চে তুলতেই হত। নূপুর উঠলেন মঞ্চে। খুব সুন্দর ভাবে আগে থেকে ঠিক করে রাখা সংলাপ বললেন। এবং সফল হলেন। হইহই রইরই বেধে গেল দেশ জুড়ে। গন্ডগোল, বিক্ষোভ, অগ্নিকাণ্ড, অবরোধ— সব কিছু হল। বিজেপির পাতা ফাঁদে পা দিলেন মুসলিমদের একটা অংশ। প্রশাসনিক ভাবে যখন সেই গন্ডগোল সামলানো গেল না, তখন পরিকল্পনা মতোই নূপুরকে সাসপেন্ড করা হল। তাতেও যখন কিছু হচ্ছে না, তখন উত্তরপ্রদেশে মাঠে নামলেন সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। বিক্ষোভ-গন্ডগোল যারা করছিলেন, বেছে বেছে তাঁদের বাড়িই ভেঙে দেওয়া হল বুলডোজার দিয়ে। সরকারি মদতে ভাঙল স্থানীয় প্রশাসন। যাঁদের বাড়ি গুঁড়িয়ে গেল, তাঁরা সকলেই মুসলিম। আসলে এটাও তো বিজেপির পরিকল্পনারই অংশ। স্থানীয় প্রশাসন ‘বেআইনি নির্মাণ’ বলল বটে, কিন্তু আইন এ ভাবে এত দ্রুত প্রয়োগ হয়ে গেল! এই ভারতে! অন্য কোনও ঘটনায় তো এতটা তৎপর নয় যোগী প্রশাসন। সরকার আসলে বুঝিয়ে দিল— বিক্ষোভ দেখাচ্ছিল, তাই শাস্তি দিতে বাড়িঘর ভেঙে দিলাম।
সরকার আসলে বুঝিয়ে দিল— বিক্ষোভ দেখাচ্ছিল, তাই শাস্তি দিতে বাড়িঘর ভেঙে দিলাম।
বিজেপি আসলে নিজেরাই সমস্তটা করল আর দোষের ভার চাপিয়ে দিল অন্যের কাঁধে। জেনেশুনে সুন্দর ভাবে বিষয়টা করা হল। করা হচ্ছে। কারণটা আগেই বলেছি। এই মুহূর্তে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। যখনই এ সব প্রশ্ন উঠবে, তখনই সুন্দর সামাজিক পরিস্থিতিকে একেবারে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হবে। আর সে সবের মূল আখর হবে ধর্ম। ধর্মের নিক্তিতে সবটা মেপে নিয়ে অশান্ত করে তোলা হবে সমাজ। তার পর শাস্তির বিধানও ওরাই ঠিক করে দেবে। বিনা বিচারে। বিনা আইনি প্রক্রিয়ায়। আদালতকে উপেক্ষা করেই শাস্তি দেওয়া হবে প্রশাসন বা সরকারি ভাবে।
বিচারের দায়িত্ব, সাজার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেওয়া ছাড়া একে আর কী-ই বা বলব! কোনও সরকার বা প্রশাসন কি এটা পারে! আদালত, আইন বিভাগ— সবটা উপেক্ষা করতে পারে এ ভাবে? না পারে না! ঠিক যেমন ভাবে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান পারেন না অভিযুক্ত এক ব্যক্তির বাড়িঘর ভেঙে দেওয়ার নিদান দিতে। এবং শেষপর্যন্ত ভেঙে দিতে। কেউ যদি দোষী হয়, কেউ যদি অপরাধী হয়, সেটা প্রমাণ হবে আদালতে। তাকে সাজার নিদান দিতে পারে একমাত্র আদালত। সরকার বা প্রশাসনের কাজ সেটা নয়। বিজেপি কিন্তু সেই লক্ষ্মণরেখা টপকে যেতে চাইছে বার বার। যাচ্ছেও।
মনে রাখতে হবে, এটা কোনও ‘রাজনীতি’ নয়। রাজনীতি এমনটা হয় না। বিজেপি দেশ জুড়ে যেটা করছে, সেটা স্রেফ ‘গুন্ডামি’!
(লেখক রাজনীতিবিদ। মতামত নিজস্ব।)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।