আলিপুরদুয়ার জেলার একটি বাগানের মহিলা শ্রমিকের সঙ্গে কথা চলছিল নির্বাচনের কয়েক দিন আগে। বললেন, “জানি, বিজেপি এলে আমাদের খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের ভাল হবে না, কিন্তু আমি এখানকার নেতাদের থেকে মুক্তি চাই, তাই বিজেপিকেই ভোট দেব।” বন্ধ বাগানের মানুষরা যেন শিখে গিয়েছে অন্ধকার ভবিষ্যৎকে সাথি করে বেঁচে থাকা। পঞ্চায়েত ভোটের পরেই চোখের সামনে বাগানের ছায়াগাছগুলো কেটে নিয়ে যাওয়া আজও তাঁরা ভুলতে পারেননি। প্রসঙ্গত, ঘরে টেলিভিশন নেই বলে ‘মোদী ওয়েভ’ কিন্তু তাঁরা দেখেননি। তাঁরা শুধু বলেন, “বাগানের মালিক থাকাকালীন চা গাছকে ছায়া-দেওয়া বড় গাছগুলো কাটলেই আমরা আন্দোলন করতাম। এখন নিজের লোকেরাই এ কাজ করছে।”
আলিপুদুয়ার হোক বা ঝাড়গ্রাম, আদিবাসীরা যে শাসক দল থেকে মুখ ফিরিয়েছে, তা পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফল থেকেই স্পষ্ট। আর রাজ্যের এ বারের ফলাফল কী বলছে? বলছে, যদিও বহু মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষ মমতাকে বেছে নিয়েছেন— কেননা, দিদির আমলে রাজ্যে মুসলিমদের উন্নয়ন না হলেও পুরো দেশ জুড়ে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মূল লক্ষ্য এখন সংখ্যালঘুরা, তাই এই নির্বাচন তাঁদের কাছে নিজেদের ‘রাজনৈতিক অস্তিত্ব’ বজায় রাখার অন্যতম উপায় হয়ে উঠেছিল। উদাহরণ— মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্র। যেখানে সারা রাজ্যে সিপিএমের ভোট বিজেপি পেয়েছে, এই লোকসভা কেন্দ্রে কিন্তু বামের ভোট রামে নয়, দিদির ঘরেই গিয়েছে। বসিরহাট, জয়নগর ও জঙ্গিপুরে একই ধারা আমরা দেখছি। অথচ অন্য দিকে, আদিবাসী ভোট কিন্তু কোনও ভাবেই রাজ্যের শাসক দলের পক্ষে যায়নি। তাই পুরুলিয়ায় কংগ্রেসের ভোট একুশ শতাংশ থেকে কমে প্রায় ছয় শতাংশে গেলেও তৃণমূলের ভোট বেড়েছে মাত্র চার শতাংশ। আর কংগ্রেস ও ফরওয়ার্ড ব্লকের ভোট গিয়ে পড়েছে গেরুয়া শিবিরে, যার ফলে বিজেপির ভোট গত লোকসভা নির্বাচনের সাত শতাংশ থেকে এ বার পৌঁছেছে উনপঞ্চাশ শতাংশে।
রাজ্যের শাসক দলের নেতাদের বোঝা দরকার, বামের ভোট রামে যাওয়াতেই কেবল তাঁদের ভরাডুবি হয়নি, নিজেদের ভোট ধরে না রাখতে পারার ফলেও সঙ্কট হয়েছে। তেমনই, রাজ্যের উদারপন্থী মানুষদেরও বোঝা উচিত রাজ্যে বিজেপির পদার্পণে গ্রামবাংলার মানুষ যে ভোট দিয়েছেন, তা শুধু হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখে নয়, বরং গণতন্ত্র ও উন্নয়নের আশায়। দার্জিলিং কেন্দ্রের ফাঁসিদেওয়া ও চটহাট অঞ্চলে মুসলিম অধ্যুষিত জায়গায় তৃণমূল সংখ্যালঘুর কিছু ভোট পেলেও তা আশানুরূপ হয়নি। এখানে তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটে থাবা বসিয়েছে কংগ্রেস, কারণ তৃণমূল নেতাদের কাজ ও ব্যবহারে সংখ্যালঘু মানুষেরা খুবই অখুশি।
রাজ্যের শাসকরা এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন, তা বোঝা যায় ছোট ছোট ঘটনাতেই। নেতাদের ওপর মানুষ এমন ভাবে আস্থা হারিয়েছেন যে মোদী সরকারের বিভিন্ন নীতির বিরুদ্ধে দিদি সরব হলেও বিশেষ সমর্থন পাচ্ছেন না। যেমন, সুপ্রিম কোর্টের একটি মামলার রায়কে কেন্দ্র করে ১৭টি রাজ্যের ৮৬ লক্ষ বনবস্তি মানুষের উপর উচ্ছেদের খাঁড়া নেমে আসতে চলেছে। আন্দোলনকারী সংগঠনগুলি জানিয়েছে যে, বনবাসীদের পাট্টা দেওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার কোনও উদ্যোগ করেনি, এমনকি সুপ্রিম কোর্টে বনবাসীদের পক্ষে সওয়াল করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার আইনজীবী অবধি পাঠায়নি। অথচ, নির্বাচনের প্রাক্কালে এমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকেও রাজ্যের শাসক দল ‘ব্যবহার করতে’ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হল।
আগামী বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের শাসক দল যে বিরোধী আসনে বসতে চলেছে, তা এখন পথেঘাটে আলোচিত বিষয়। রাজ্যে বাম জমানার শেষ দশকে শাসক দলের নেতাকর্মীদের দম্ভ, দখলদারিত্ব, সাধারণ মানুষের থেকে দূরত্ব চৌত্রিশ বছরের শাসনকে একলহমায় সরিয়ে দেওয়ার কারণ হয়েছিল। সেই একই দোষে টিএমসিরও একই শাস্তি হবে না-ই বা কেন! বড় পুঁজির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যদি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কৃষক, খেটেখাওয়া অগণিত গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের আন্দোলনধারাতেই টিএমসি উঠে এসে থাকে, তা হলে তো সেই মানুষদের জীবনজীবিকাকে সুরক্ষিত করা ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া শুধু দানখয়রাতি ও ভাতার মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। তার জন্য দরকার ছিল সুস্পষ্ট নীতি নির্ধারণ ও প্রণয়ন যা এই ছোট-প্রান্তিক সত্তাগুলোকে একটা সমন্বয়ের মধ্যে নিয়ে আসতে পারত।
এই যেমন, এক-একটি গ্রামপঞ্চায়েতকে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে সরকার থেকে, কিন্তু তার কানাকড়িও গ্রামীণ কর্মসংস্থান বাড়াতে খরচ হয়নি। বরং শুধু রাস্তাঘাট বানিয়ে এলাকার শাসক দলের লোকেদের পকেটের ‘উন্নয়ন’ ঘটেছে। শাসক দলের সেনা এতটাই মরিয়া যে গ্রামের মানুষকেও ভোট দিতে যেতে দেওয়া হয়নি, গণতন্ত্রে এতটাই তাঁদের অবিশ্বাস। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের স্পষ্ট নীতি ছাড়া, এসএসসি ও সরকারি নিয়োগের সঙ্কটের সমাধান ছাড়া, আর্থিক উন্নয়নের দিশা ছাড়া আগামী দুই বছরে মানুষের আস্থা পুনরর্জন করে ফেলা— বড়ই কঠিন, এমনকি অসম্ভব বলা চলে।