গত দু’দশকে টেলিফোন যেমন স্মার্টফোনে বদলে গিয়েছে, আর পাড়ার আড্ডা বদলে গিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়— তেমনই বিবাহের যৌতুক বদলে গিয়েছে উপহারে, আর পুত্রবধূর মাপকাঠি ‘ঘরোয়া’ থেকে বদলে হয়েছে ‘শিক্ষিত ও ঘরোয়া’।
এ দেশের মহিলারা যে প্রকৃত অর্থেই ‘শিক্ষিত ও ঘরোয়া’ হয়ে উঠেছেন, তার প্রতিফলন পাই সমসাময়িক ভারতীয় তথ্যভান্ডার ও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে। ২০১৯ সালের হিসেবে যেখানে এ দেশের যথাক্রমে ৯৩% ও ৭৫% মেয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় নথিভুক্ত হয়েছে, সেখানে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণ সাকুল্যে মাত্র ২০%। এমন ভাবার কোনও কারণ নেই যে, এই বৈপরীত্য শুধুমাত্র সমসাময়িক। ১৯৭০-এর দশক থেকেই এ দেশে মহিলাদের শিক্ষার হার নাগাড়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের হার ১৯৯০ থেকে ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। ২০০৫ সালের পর থেকে এই হার প্রবল ভাবে কমতে শুরু করেছে। মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের নিরিখে ভারত আজ প্রতিবেশী চিন, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানেরও পিছনে।
অথচ, লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে এবং কোনও দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে মহিলাদের বেতনভিত্তিক কাজে অংশগ্রহণের ভূমিকা একবাক্যে স্বীকার করেছে কার্যত সব গবেষণা। মহিলারা কর্মরত হলে এক দিকে যেমন তাঁদের ও সন্তানের পর্যাপ্ত পুষ্টি হয়, শিশুর বিদ্যালয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়; তেমনই অন্য দিকে সংসারে ও সমাজে তাঁদের সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি এ-ও দেখা গেছে যে, এক জন কর্মরতা মহিলা তাঁর আশেপাশের আরও অনেক মহিলাকে সংসারের গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে এসে কাজে যোগদান করতে অনুপ্রাণিত করেন। গার্হস্থ শ্রম সংক্রান্ত বেশ কিছু গবেষণা দেখাচ্ছে, যে সব অঞ্চলে বা পরিবারে ঘরোয়া কাজকর্মের দায়িত্ব মূলত মহিলাদেরই, সে সব অঞ্চলেও মহিলারা কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করলে পুরুষরা অনেকাংশে গৃহকর্মের দায়িত্ব ভাগ করে নিতে শেখেন।
বেতনভিত্তিক কাজে মহিলাদের অংশগ্রহণ দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক বৃদ্ধির পক্ষেও গুরুত্বপূর্ণ। এক অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থার ২০১৮ সালের একটি প্রতিবেদন বলছে, ভারতে মহিলারা যদি কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের সমান অংশগ্রহণের সুযোগ পেতেন, তা হলে এ দেশের জিডিপি বর্তমান হারের ১৮% বেশি বৃদ্ধি পেত।
কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণের প্রথম জোয়ার আসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। পুরুষেরা দলে দলে যুদ্ধে যোগদান করলে, বেঁচে থাকার ন্যূনতম রসদ জোগাতে মহিলারা কাজে যোগ দেন। কিন্তু মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে এই প্রয়োজনভিত্তিক যোগদান দীর্ঘ দিন স্থায়ী হয়নি। বিশ্বযুদ্ধের অবসানের কয়েক বছরের মধ্যেই মহিলাদের অবস্থান আবার ঘরোয়া গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ হয়। অতঃপর সত্তরের দশক থেকে মূলত নারী আন্দোলনের হাত ধরে ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়, বিশেষত উন্নত দেশের জনসাধারণের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণের গুরুত্ব অনুভূত হয়। নরওয়ে, ডেনমার্ক, কানাডা, সুইডেন, আইসল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণের পরিমাণ ক্রমশ বাড়তে থাকে।
ভারতে কিন্তু তা হল না। এ দেশে নারীর বেতনভিত্তিক কাজে অংশগ্রহণের বিষয়টি কোনও দিনই সে অর্থে সরকারি কর্মসূচিতে স্থান পায়নি। স্থান পেয়েছে মেয়েদের শিক্ষার হার, যা আবার দীর্ঘ দিন সীমাবদ্ধ ছিল শুধুমাত্র সাক্ষরতার হারে। এর পিছনে দু’টি কারণ থাকতে পারে। এক, এ দেশে মেয়েদের শিক্ষিত করার বিষয়টিকে শুধুমাত্র একটি ‘টার্গেট’ হিসেবে দেখা হয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরেই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলি উন্নয়নের স্বার্থে বিশ্বের সকল দেশের জন্য নারী শিক্ষাহার বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছে, এবং বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে তদারকিও করেছে। কিন্তু, এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ এ দেশে একটি ‘টাস্ক’ হিসেবেই রয়ে গিয়েছে, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তার মূলগত প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়নি এতটুকু। অথবা, ধরেই নেওয়া হয়েছে যে, শিক্ষার অদৃশ্য হাত মেয়েদের শ্রমের বাজারে স্বয়ংসিদ্ধ অংশগ্রহণ ঘটাবে, তার জন্য পৃথক ব্যবস্থার দরকার হবে না। বাস্তবে যে তা হয় না, উন্নততর দেশগুলি তার প্রমাণ বহন করছে।
নারী-কল্যাণের কাজে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার বিশেষ প্রয়োজন ছিল। কারণ নারী-আন্দোলনের মাধ্যমে যে নারী-উন্নয়নের কথা আগে বলেছি, তা মূলত পাশ্চাত্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। নারীর অধিকার স্থাপনে, এ দেশে আমরা কোনও স্বতঃস্ফূর্ত নারী-আন্দোলন দেখতে পাই না। বরং, এ দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা হয়েছে সরকারি বা আধা-সরকারি সংস্থাগুলির সিদ্ধান্তের ফলে। এমনকি এ দেশে ‘মানবীবিদ্যা’ (উইমেন স্টাডিজ়) স্বতন্ত্র পাঠ্যক্রম ও গবেষণার শাখা হিসেবে গড়ে উঠেছে সরকারি মধ্যস্থতাতেই।
এইটুকু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও ক্রমশ ম্লান হয়ে গেল। সঙ্গে ধারাবাহিক ভাবে যুক্ত হল রাজনৈতিক প্ররোচনা। কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণের কাঙ্ক্ষিত ফলই যেখানে পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিসর তৈরি হওয়া, সেখানে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের একের পর এক মন্তব্য চোখে পড়ার মতো। কেউ বলছেন, মহিলারা স্বাধীন থাকার বা স্ব-সিদ্ধান্ত গ্রহণের যোগ্যই নন, নারী-স্বাধীনতা বরং সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর। আবার কেউ বলছেন, মহিলারা নিজের কাজে মগ্ন হয়ে থাকলে স্বামী-সংসারের খেয়াল রাখবে কে? তাই সংসারের খেয়াল রাখতে মহিলাদের হতে হবে ‘ঘরোয়া’ আর আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশের উন্নয়নের মুখরক্ষায় মেয়েদের হতে হবে ‘শিক্ষিতা’।
পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপনের ভাষা যেন ঠিক সমাজের আয়নাটি।