ইতিবাচক: কলকাতা বইমেলায় ভিড়। নিজস্ব চিত্র
সদ্য সমাপ্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা। মেলা শেষে দু’টো ইতিবাচক দিক খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। প্রথমটি হল, গত বছরের তুলনায় বইমেলায় সমাগম বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে বই বিক্রির পরিমাণও। বাংলা ভাষা, প্রকাশক ও পাঠকের ক্ষেত্রে এই তথ্য অবশ্যই সুখবর। বিক্রি বাড়লে প্রকাশক বাঁচেন। আবার বিক্রি বাড়লে বইয়ের দামও কমে। পাঠকের সুবিধা। প্রকাশক ও লেখক উভয়েরই আর্থিক সমস্যাও মেটে।
বইমেলার এই তথ্য আবার দু’টো প্রশ্নেরও জন্ম দিচ্ছে। বইমেলার সঙ্গে জেলার যোগ কতটা? আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলার সঙ্গে কি রাজধানী সংলগ্ন জেলারই বেশি যোগ? দূরতম জেলাগুলোকে যোগ করা গিয়েছে বইমেলার সঙ্গে? আরেকটি প্রশ্ন, ছাপা বইয়ের বিক্রি বাড়ছে। তাহলে কি বইয়ের ভবিষ্যৎ ইন্টারনেটে বলে যে দাবিদাওয়ার কথা শোনা যাচ্ছিল তা কিছুটা ধাক্কা খেল!
কলকাতা বইমেলার ক্ষেত্রে সংলগ্ন জেলা বা প্রান্তিক জেলা বলে কিছু হয় না। জানালেন জেলার একাধিক ব্যক্তি। যাঁরা কোনও না কোনও ভাবে বইয়ের সঙ্গে যুক্ত। কেউ লেখক, কেউ প্রকাশক। এঁদের পাঠকের সঙ্গেও যোগাযোগ রয়েছে। তাঁদের বক্তব্যের নির্যাস হল, বইমেলা দূরতম জেলাতেও উন্মাদনা আনে। কেমন উন্মাদনা তার উদাহরণ দিচ্ছিলেন অচিন্ত মারিক। মেদিনীপুর শহরের বাসিন্দা। লেখক ও প্রকাশক। অচিন্ত জানালেন, বইমেলা ঘোষণার সঙ্গেই জেলাতেও একটা প্রভাব পড়ে। চায়ের দোকানে, ঘরোয়া আড্ডায় বইমেলার কথা ওঠে। কী ভাবে যাওয়া যায়, কবে যাওয়া হবে তার প্রস্তুতি শুরু হয়। একই কথা বলছিলেন পূর্ব মেদিনীপুরের একটি নামী লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক প্রাণনাথ শেঠ। তিনি জানালেন, জেলায় যাঁরা লেখালেখি করেন তাঁরা একদিন অন্তত বইমেলায় যান। প্রতি বছরই একই ছবি। তাঁর দাবি, এ বছরে হলদিয়া থেকে চারটি দল বইমেলা গিয়েছে। মেচেদা তমলুক, কাঁথি, এগরা, নন্দীগ্রাম থেকে অন্তত দু’টো করে দলের বইমেলা যাওয়ার খবর তাঁর কাছে রয়েছে। একই কথা বলছিলেন অচিন্তও। তিনি জানিয়েছেন, পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে প্রতি বছর অরুণ দাশ, অমিত পণ্ডিত, রামকৃষ্ণ মহাপাত্র, অভিনন্দন মুখোপাধ্যায়, নিলয় পাল, অচিন্ত্য নন্দী নিয়মিতও যান। এঁরা লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। প্রতি বছরই দল বেঁধে কলকাতা বইমেলায় যান।
কিন্তু অচিন্ত বা প্রাণনাথ, দু’জনের কথাতেই আরও একটি প্রসঙ্গ উঠে আসছে। যা নিয়ে মাঝে মধ্যে বিতর্ক সভাও হয়। তা হল, তাহলে কি লেখকেরাই এখন মূল পাঠক? এমন প্রশ্ন কঠোর ভাবেই অস্বীকার করলেন দু’জনেই। তাঁদের দাবি, অবশ্যই পাঠকেরা জেলা থেকে কলকাতা বইমেলা যান। প্রাণনাথের কথায়, ‘‘লেখকেরা যাচ্ছেন দেখে অনেকেই তাঁদের সঙ্গী হচ্ছেন। আমি প্রতি বছর যাই। এ বছর যেতে পারিনি। তা নিয়ে মনোকষ্টে আছি। কিন্তু দুই শিক্ষককে পাঠিয়ে বই আনিয়েছি।’’ একই কথা অচিন্তেরও। তিনি বললেন, ‘‘আমি একজনকে চিনি যিনি শ্রেষ্ঠ পাঠক হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন জেলায়। উনি প্রচুর বই কেনেন। এ বছরও গিয়েছিলেন। আমার সঙ্গেও চারজন গিয়েছেন মহা উৎসাহে। কেনার ক্ষমতা অনুযায়ী বই কিনেছেন। বহু সাধারণ পাঠক রয়েছেন। তাঁরাও যান। আলোচনা, আড্ডাতেও অংশ নেন।’’ লেখক তথা লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক ঋত্বিক ত্রিপাঠীও জানিয়েছেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ। মেদিনীপুর জেলার প্রান্ত থেকে কলকাতার সল্টলেকে যাওয়া এবং ফেরাটা বেশ অসুবিধের। কিন্তু কিছু জন তবুও যান।
যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে অবশ্য ভিন্নমতই জানা গেল। প্রাণনাথ শেঠ বললেন, ‘‘হলদিয়া টাউনিশিপ, দুর্গাচক, মহিষাদল, তমলুক থেকে দক্ষিণবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণের বাস দেওয়া হয়েছিল। ট্রেনে সময় বেশি লাগে। তার পর হাওড়া থেকে আবার বাস ধরে সল্টলেকের করুণাময়ী যাওয়া ঝামেলার। আমরা বাসে যাই না। সকলে মিলে গাড়ি ভাড়া করে যাই। ফলে ফেরার ঝামেলা থাকে না।’’ অচিন্ত মারিকের কথায়, ‘‘বইমেলার সঙ্গে অনেকের আত্মিক যোগ আছে। আবার বুড়ি ছোঁয়াও রয়েছে। ফেরার তাড়ায় তাড়াতাড়ি মেলা থেকে বেরিয়ে যেতে হয়। এই বছর খড়্গপুর থেকে দক্ষিণবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার বাস ছেড়েছিল। কিন্তু মাত্র তিনদিন। অনেকে বিষয়টি জানতেই পারেননি।’’
বাসের প্রচারের অভাবের অভিযোগ মিলেছে ঝাড়গ্রাম থেকেও। ঝাড়গ্রাম থেকে ছ’দিন দক্ষিণবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার বিশেষ বাস ছেড়েছিল কলকাতা বইমেলার উদ্দেশ্যে। ২৯ জানুয়ারি এবং ১, ২, ৫, ৮ ও ৯ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় ঝাড়গ্রাম ছেড়ে বাসটি মেদিনীপুর শহর হয়ে বইমেলায় পৌঁছত বিকাল ৩টায়। আবার সন্ধ্যা ছ’টায় বইমেলা চত্বর ছেড়ে বাসটি রাতে ঝাড়গ্রামে ফিরত। প্রচারের অভাবে অনেকেই বাসের কথা জানতেন না। ঝাড়গ্রামের সাহিত্যের আড্ডার কবি রাজা ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘বাসের কথা জানতাম না। ট্রেনে কলকাতায় গিয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছিলাম। সেখান থেকেই একদিন বইমেলায় গিয়েছিলাম। বাসের কথা জানলে আমাদের সাহিত্যের আড্ডার আরও সদস্য বইমেলা যাওয়ার সুযোগ পেতেন।’’
তবে বাসে যাঁরা গিয়েছেন তাঁদের অভিজ্ঞতা বেশ ভাল। ঝাড়গ্রামের সেবায়তন শিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ আশিস গুপ্ত বলেন, ‘‘গত শনিবার সরকারি বাসে কলেজের শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরা বইমেলায় গিয়েছিলেন। বইমেলা থেকে কলেজের জন্য প্রায় চল্লিশ হাজার টাকার বই কেনা হয়েছে। ব্যবস্থা খুব ভাল ছিল। ফেরার সময়ে বাসের কর্মীরা কলেজে বই নামিয়েও দিয়েছিলেন।’’ এসবিএসটিসি-র ঝাড়গ্রাম ডিপোর আধিকারিক শীতল চক্রবর্তী বলেন, ‘‘ওয়েবসাইটে বাসের কথা জানানো হয়েছিল। অনেকেই বাসে বইমেলায় গিয়েছিলেন।’’
যোগাযোগ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কিন্তু ই-বুক আর ছাপা বইয়ের দ্বন্দ্ব? অচিন্ত বলেলেন, ‘‘বইমেলার মিডিয়া সেন্টারে ৯ ফেব্রুয়ারি ‘আধুনিক প্রযুক্তির বই ও মুদ্রিত পুস্তক’ শীর্ষক একটি আলোচনা ছিল। সেই আলোচনায় আমি বলেছিলাম, মুদ্রিত বইয়ের মধ্যে একটি স্বচ্ছতা রয়েছে। বানান ভুলের বা তথ্যভ্রান্তির সমস্যা তেমন থাকে না। ছাপা বই পড়ার যে আনন্দ ও নস্টালজিয়া থাকে তা ইন্টারনেটে বই পড়ার মধ্যে নেই। কতজন ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন সেটাও দেখা দরকার।’’ প্রাণনাথেরও মত, ই-বুক একেবারেই আবেগ শূন্য। ই-বুক পাঠের প্রতিক্রিয়া একদমই ভাল নয়। ছাপা অক্ষরের আলাদা একটা গুরুত্ব আছে। ভাবনার দিক থেকে অনেক বেশি স্থায়ী। তাঁর মত, ইন্টারনেটে লেখালেখি বা সোশ্যাল মিডিয়ায় তার শেয়ার থেকে সত্যি প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় না। তবে একমত নন ঋত্বিক ত্রিপাঠী। তাঁর মতে, ‘‘হালের পাঠক বইমুখী নয় সিলেবাসের চাপ ইত্যাদি কারণে। ই-বুকে বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে তাদের বইমুখী করা গিয়েছে। তারা খোঁজখবর রাখছে। এটা অবজ্ঞা করা যাবে না। তবে ইন্টারনেটে পড়তে নানা কারণে মগ্নতার সমস্যা হয়।’’
তথ্য সহায়তা: কিংশুক গুপ্ত