এখন গ্রন্থকর্তা ঘরে ঘরে, এডিটর বহু নরে, প্রকাশক থরে বিথরে

গ্রন্থ-সংস্কৃতি শিখতে হবে

এই একুশ শতকে প্যারী কবিরত্নের পদ্য আবার নতুন করে মাঝে মাঝে ঘাই মারে। চার দিকে তাকিয়ে মনে হয় এখন গ্রন্থকর্তা ঘরে ঘরে, এডিটর বহু নরে। প্রকাশকও থরে বিথরে।

Advertisement

বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৬:০০
Share:

সময়টা উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ। বাংলা মুদ্রণের বয়স খুব বেশি নয়। তবে সাময়িকপত্রের দাক্ষিণ্যে বাংলায় লেখালিখি বেশ জমে উঠেছে, সে-সব ছাপা হচ্ছে। বই ও সাময়িকপত্রের নয় নয় করেও বেশ কাটতি। এক লেখকের সঙ্গে অন্য লেখকের বইয়ের ভাল-মন্দ নিয়ে তর্ক জমে উঠছে। সেই সময় প্যারী কবিরত্ন পদ্যে ফুট কাটলেন, ‘এখন গ্রন্থকর্ত্তা ঘরে ঘরে,/ Editor বহু নরে,/ কিন্তু কলম যে কিরূপে ধরে তা’ অনেকে জানে না।’ লিখতে না-জানুক, প্রকাশকের দেখনদারির অবশ্য খামতি ছিল না। সুতরাং পুনশ্চ প্যারী কবিরত্নের ফুট, ‘কাগজগুলো কেবল ভাল,/ Binding পরিপাটি’।

Advertisement

এই একুশ শতকে প্যারী কবিরত্নের পদ্য আবার নতুন করে মাঝে মাঝে ঘাই মারে। চার দিকে তাকিয়ে মনে হয় এখন গ্রন্থকর্তা ঘরে ঘরে, এডিটর বহু নরে। প্রকাশকও থরে বিথরে। পাণ্ডুলিপি ও টাকা দিলেই তাঁরা বাছ-বিচার না করে বই ছেপে দেবেন। কেউ বলতেই পারেন ‘তা হোক না বাপু রাশি রাশি, বই-ই তো ছাপছে, মানুষ তো আর খুন করছে না।’ হক কথা। বই-ই ছাপছে। তা ছাপুন। শুধু ছাপার আগে এক বার ভাবুন বই ছাপতে গেলে শিখতে হয়, চাখতে গেলে শিখতে হয়, লিখতে গেলেও শিখতে হয়। গ্রন্থ-সংস্কৃতি কথাটা তো আর গাছে ফলে না। তার সঙ্গে শিক্ষা-অনুশীলন-পরিশীলনের সম্পর্ক গভীর। সে শিক্ষাকৌলীন্য বাঙালিদের মধ্যে কেউ কেউ অর্জন করেছিলেন। সেই কৌলীন্যের স্মৃতি ও ইতিহাস মাঝে মাঝে স্মরণ করলে আমাদের সমষ্টিগত পাপ খানিকটা প্রশমিত হতে পারে।

নিকট অতীতকালের সেই তাঁদেরকে কী বলে অভিহিত করব? তাঁরা বইপ্রেমিক, বইসাধকও। প্রেমের সঙ্গে সাধনার ঠিক-ঠিক যোগ হওয়া চাই। পুলিনবিহারী সেন, প্রভাতকুমার ঘোষ, বিমান সিংহ, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এই নামগুলির সঙ্গে আম-পাঠকের পরিচিতি নেই বড় একটা। তাঁরা লেখক নন, প্রচ্ছদ বা অলংকরণ শিল্পীও নন। আলোর সামনে এসে নিজেদের জাহির করার ‘অশালীনতা’ থেকে তাঁরা মুক্ত। বই নির্মাণের তাঁরা নেপথ্য শিল্পী। ‘নামহীনতার দিকে’ই যেন যেতে চান তাঁরা। পুলিনবিহারী সেনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে লিখেছেন শঙ্খ ঘোষ, ‘নিজেকে আড়াল করে রাখার এই প্রবণতা তাঁর ব্যক্তিজীবনেও আমরা দেখেছি বারবার।’ বিশ্বভারতীর গ্রন্থনবিভাগের কোনও প্রদর্শনী চলছে। একটি ঘরে চুপ করে বসে আছেন পুলিনবিহারী। চোখে মুখে প্রসন্নতা। রবীন্দ্ররচনাকে যত্ন করে প্রকাশ করাই যে তাঁর ব্রত। রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালেই সে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন তিনি। লেখার শব্দশুদ্ধি নিয়ে তাঁর মনোযোগ যে কী গভীর। পুলিনবিহারী রবীন্দ্রনাথকেও মাঝে মাঝে নানা পরামর্শ দিতেন, রবীন্দ্রনাথও অনেক সময় সায় দিতেন তাতে। এই পুলিনবিহারী অবশ্য বলতেন, ‘আমি একজন সামান্য শ্রমিক মাত্র।’

Advertisement

ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন মুদ্রণশিল্পী প্রভাতকুমার ঘোষ। ১৯৩৫-এ ম্যাট্রিকে প্রথম, ১৯৩৭-এ রিপন কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে প্রথম, ১৯৩৯-এ প্রেসিডেন্সি থেকে ইংরেজি অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। ১৯৪৩-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ-তে প্রথম শ্রেণিতে চতুর্থ। বঙ্গবাসী কলেজে মাস ছয়েক পড়িয়ে গেলেন বিজ্ঞাপন জগতে। তার পর সেখান থেকে সরে এসে নিজের ইস্টএন্ড— মুদ্রণশিল্পের সে এক নিজস্ব ভারতীয় ঘরানা। প্রভাতবাবুকে সাহেবরা পর্যন্ত ভয় করতেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের এক সাহেব ডেপুটি ম্যানেজার এন্টালিতে প্রভাতবাবুর ছাপাখানায় ঝাড়া তিন ঘণ্টা বকুনি খেয়েছিলেন। সুবোধ সেনগুপ্ত, অশোক মিত্র, রণজিৎ গুহ প্রভাতবাবুর হাতে পাণ্ডুলিপি সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত। প্রভাতবাবু মনে করতেন ‘লেখকের অভিপ্রায় আর পাঠকের বোঝার মধ্যে সব ফাঁক ভরানোর দায় তাঁর’, মুদ্রাকরের। তবে সে চিহ্নগুলি যত্ন করে মুছে ফেলবেন তিনি। কপিতে সবুজ কালিতে প্রশ্ন ও সংশোধন উৎকীর্ণ করতেন এই ‘প্রিন্টার্স রিডার’, আদতে তিনি প্রেসের মালিক— নেপথ্যচারী সুশিক্ষিত গ্রন্থনির্মাতা। প্রভাতবাবুর সূত্রে অধ্যাপক স্বপন চক্রবর্তী স্মরণ করেছেন তাঁর মাস্টারমশাই অশোককুমার ঘোষের কথা। অশোককুমার ঘোষ প্রভাতবাবুর যোগ্য পুত্র। ম্যাসাচুসেট্‌সের স্মিথ কলেজের এক বাঙালি অধ্যাপক শেক্সপিয়রের ‘অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিয়োপেট্রা’ নিয়ে একটি লেখা পাঠিয়েছেন। লেখায় একটি ফরাসি শব্দ নিয়ে অশোকবাবুর খটকা। তা নিরসনের পর তিনি যেন পরিত্রাণ পেলেন।

নেপথ্যচারী শিক্ষিত মানুষজনের কথা উঠে আসছে এই মুহূর্তে যাঁকে ঘিরে (গ্রন্থনির্মাতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য/ মননে ও যাপনে, সম্পাদনা শিলাদিত্য সিংহ রায়, অভিযান) তিনি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সংস্কৃত, ইংরেজি, বাংলা, হিন্দিতে পারঙ্গম মানুষটি ছিলেন প্রভাতকুমার ঘোষের যোগ্য উত্তরসূরি। সংস্কৃত কলেজ থেকে বি এ পাশ করেছিলেন। তাঁদের কিছু ক্লাস হত প্রেসিডেন্সিতে। সেখানে অমর্ত্য সেন ছিলেন তাঁর সহপাঠী। বইয়ের প্রতিটি অঙ্গের প্রতি বুদ্ধদেবের ছিল গভীর নজর। চাইতেন ব্লার্ব হবে ‘মুচমুচে’। প্রুফ দেখা হবে তিন জোড়া আলাদা আলাদা চোখে। অক্ষরের চরিত্র বিষয়ে ছিলেন অসম্ভব খুঁতখুঁতে। বইয়ের শরীর তাঁর কাছে ‘তত্ত্বকথা’ নয়, হাতেকলমে প্রতিটি অঙ্গ নির্মাণের অভিজ্ঞতায় তাঁর মন ও মনন ছিল সমৃদ্ধ। কলকাতাতে কাজ শুরু করলেও দিল্লিতেই তাঁর মননের সাম্রাজ্য, কর্মজগতের বিস্তার। কাজ করতে গিয়ে অবাঙালিদের নানা বিচিত্র বাংলা শব্দ শিখিয়ে দিতেন। শেফালী মৈত্র লিখেছেন চমৎকার এক বৃত্তান্ত। বই তৈরি করতে গিয়ে গুরুতর কোনও ভুল হলে তিনি বলতেন, ‘রাম কেলো হয়েছে।’ তাঁর হিন্দিভাষী সহকর্মীরা তাঁকে দাদা ও গুরু মানত। গুরুর বাংলাকে তারা নিজের ভাষায় অনুবাদ করে নিয়েছিল। এক দিন অসংশোধনীয় ত্রুটি চোখে পড়তেই দল বেঁধে হাজির বুদ্ধদেবের কাছে, ‘দাদা, তাগড়া কেলো হো গিয়া।’ বইয়ের মার্জিন নিয়ে অতি সচেতন ছিলেন তিনি। বলতেন ‘বইয়ের ক্ষেত্রে স্পেস হল নীরবতা।’ বইয়ের শরীরের সঙ্গে বইয়ের বিষয়ের যেন যোগ থাকে, শরীর যেন বিষয়ের থেকে দেখনদার হয়ে না ওঠে। কবিতার বই যে টাইপফেসে ছাপা হয়, সে টাইপফেসে বিজ্ঞানের বই ছাপা চলে না। কবিতার বই ছাপার জন্য চাই অন্য রকম মর্জি। শচীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার বই ‘মৃত্যুটাকে ভুলতে চাই’ ছেপেছিলেন টিবেটান রাইস-পেপারে।

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সূত্রে যাঁদের কথা এল, তাঁরা লেটার প্রেসের আওতায় তাঁদের সেরা কাজগুলি করেছিলেন। এখন মুদ্রণ প্রযুক্তির চেহারা চরিত্র বদলে গেছে। বুদ্ধদেববাবুর গুণমুগ্ধ ‘বইবাহিক’ শিলাদিত্য সিংহ রায় এই নতুন সময়ের চিহ্নগুলিকে ঠিকই লক্ষ করেছেন। অনলাইন ট্রেডিং-এর সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে ডিস্ট্রিবিউশন, হোলসেলিং ও রিটেলিং-এর সাবেকি মডেল তছনছ হয়ে গেছে। এসেছে অ্যাপল ম্যাক বা কিন্ডল পেপারহোয়াইট। ফটোকপি আর পিডিএফ মূল বইকে রূপান্তরিত করছে চটজলদি তথ্য আহরণের সহজ পণ্যে। নানা চেহারার এই সহজ প্রাচুর্য যেমন আছে, তেমনই মুদ্রণপ্রযুক্তির সহজ ব্যবহার এক রকম যান্ত্রিক ঝকঝকে চেহারা তৈরি করছে বইয়ের। তাতেই অনেকের মন ভুলছে। এই অসময় কীভাবে যাপন করতেন এই সাবেকি গ্রন্থ-সংস্কৃতির বাঙালি মহাজনরা? অসময়ের মধ্যেই তো সুসময় নির্মাণে সচেষ্ট থাকতে হয়। যে উর্বশী বুটালিয়া ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাবলিশার হিসেবে ২০১৭-তে গ্যেটে পদকে সম্মানিত, তাঁকে তো এক কালে কাছ থেকে দেখেছিলেন বুদ্ধদেব, দেখেছিলেন কপি এডিটিং-এর প্রাথমিক পাঠ নিতে। শিক্ষা আর পরিশীলনের বিকল্প নেই। এই সময়েও শিক্ষা আর পরিশীলনই পারে গ্রন্থ-সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে। এই শিক্ষা বিনয় দেয়, অহেতুক ঢাক পেটানো থেকে বিরত রাখে, আর মনোযোগী করে শুধু বইয়ের প্রতি।

বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement