হতাশা কাটিয়ে নতুন করে বাঁচছে কোয়াডেন। ছবি: রয়টার্স।
অস্ট্রেলিয়ার কোয়াডেন বেলেস এখন একটা পরিচিত নাম। ক’দিন আগেও ন’বছর বয়সি এই বাচ্চাটি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। তার কান্নায় ভেঙে পড়া আর বার বার আত্মহত্যা করতে চাওয়ার ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেছিলেন তার মা।
ঠিক কোন পরিস্থিতিতে একটা ন’বছরের শিশু আত্মহত্যা করতে চায়, যখন তার ‘আত্ম’-এর বোধটাই ভাল ভাবে গড়ে ওঠেনি? কোয়াডেনের এই বিপর্যয়ের পিছনে রয়েছে একটা ছোট শব্দবন্ধ— ‘বডি শেমিং’। বয়সের তুলনায় খর্বকায় কোয়াডেনের ন’বছরের জীবনকেই নরক করে ছেড়েছে তার সহপাঠীরা। তার উচ্চতা নিয়ে সর্বদাই তাকে খোঁচাতে খোঁচাতে দেওয়ালে ঠেসে ধরা হয়েছিল তাকে।
এমতাবস্থায়, নিজের অস্তিত্বের সঙ্কটকে টের পায় শিশু কোয়াডেন, যা ওই বয়সে পাওয়ার কথাই নয়। এবং সে নিজেকে এই বৈরী জগৎ থেকে সরিয়ে নিতে চায়। হৃদয়বিদারক এই ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের কোণে কোণে। বডি শেমিংয়ের বিরুদ্ধে সরব হন হলিউড স্টার হিউজ্যাকম্যান-সহ অগণিত মানুষ। কোয়াডেনকে সাহস দিয়েছেন প্রত্যেকেই। জানিয়েছেন, সে একা নয়, দুর্বল নয়।
মায়ের সঙ্গে কোয়াডেন। -ফাইল চিত্র।
আরও পড়ুন: ‘অপমানের’ কৃষ্ণবর্ণই তুরুপের তাস, উদ্বাস্তু শিবিরের অভুক্ত বালিকা আজ বিশ্বসেরা মডেল
কোয়াডেনের ভেঙে পড়ার ভিডিয়োটি তার মা জনসমক্ষে নিয়ে না এলে কী হত? হয়তো সত্যিই বাঁচত না শিশুটি অথবা হয়তো বাঁচত, হীনমন্যতায় নুয়ে, ঠোক্কর খেতে খেতে বাঁচত। এই বেঁচে থাকা হত না-বেঁচে থাকারই নামান্তর। বডি শেমিং বা চেহারা তুলে কটাক্ষ বা খোঁটা যে একটা অপরাধ, নৈতিক দৃষ্টিতেও অন্যায়— এই বোধের অভাব পৃথিবীর সর্বত্রই। তা থেকে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য কেউই মুক্ত নয়। কালো মানুষকে ধলা মানুষ ঘৃণা করে শুধুমাত্র তার গাত্রবর্ণের কারণে। ‘পিগমি’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় ‘ঊণ’ বা ‘নিকৃষ্ট’-এর বিশেষণ হিসেবে। এ ভাবেই লম্বা মানুষ খর্বকায়কে, সুগঠিত মানুষ স্থূলকায়কে, ক্ষীণকায়কে আড়নজরে দেখে এসেছে, তাকে খোঁচা দিয়েছে, ক্রমাগত ঠেলতে ঠেলতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দিয়েছে।
এই সেই ভিডিয়ো, যা তোলপাড় করেছে বিশ্বকে
কিন্তু এই ছবি কি সর্বকালের? হিন্দু পুরাণের দিকে তাকালে তো অন্য রকম মনে হয়। হিন্দু দেবদেবীদের অনেকের স্তোত্রই শুরু হয় তাঁদের শরীরী বর্ণনা দিয়ে। সিদ্ধিদাতা গণেশের কথাই যদি ধরা যায়, তা হলে দেখা যাবে তাঁর বন্দনা শুরুই হয় ‘বক্রতুণ্ড মহাকায়’ দিয়ে। গণেশের আর এক নাম ‘লম্বোদর’। কই, স্থূলকায় বলে তো তাঁকে অন্য দেবতারা একবারও ‘শেমিং’ করেননি। দেবীদের অনেকের স্তুতিতেই আসে তাঁদের শরীরী সৌন্দর্যের বর্ণনা। তা নিশ্চয়ই ভক্তের মনে কামভাব জাগানোর জন্য রচিত নয়। পৌত্তলিক হিন্দু ধর্ম আসলে দেবতাদের অবয়বকে বাস্তবসম্মত ভাবেই উপস্থাপন করেছিল। দেবতাকে সুদূর নীহারিকা বলে যাতে মনে না করা হয়, তার জন্যই কি এই বন্দোবস্ত? দেবতাদের মানবায়ন ঘটাতে গেলে, মানব চরিত্রের দোষ-গুণ যেমন তাঁদের উপরে আরোপিত হয়, তেমনই মানুষের চেহারাও তাঁদের উপরে চেপে বসে। ফলে খোঁচা বা কটাক্ষ সেখানে আসতেই পারে না।
আরও পড়ুন: বডি শেমিংয়ের প্রতিরোধ হোক হাসিমুখে
যামিনী রায়ের আঁকা বাংলার নাদুসনুদুস শিবঠাকুর।
পুরাণে বালখিল্য মুনিদের কথা রয়েছে, যাঁরা একান্ত ভাবেই ক্ষুদ্রকায়। রয়েছে অষ্টাবক্র মুনির কথা, যাঁর শরীর বাঁকাচোরা। কিন্তু কেউ তাঁদের অসম্মান করে পার পেয়েছে, এমন কথা কোথাও পাওয়া যায় না। বরং নিজগুণে অমিততেজা এই সব মুনি, বডি শেমিংকে তুড়িতে উড়িয়ে টক্কর দিয়েছেন তথাকথিত ‘স্বাভাবিক’ দুনিয়ার সঙ্গে। মঙ্গলকাব্যে মনসাকে ‘চেঙমুড়ি কানী’ বলে চাঁদ সওদাগর কটাক্ষ করলেও দেখা যায়, তার ফল ভাল দাঁড়ায়নি। সুতরাং ধরে নেওয়া যেতে পারে, মধ্যযুগের নৈতিকতাতেও এ দেশে দৈহিক অসঙ্গতি নিয়ে ব্যঙ্গ মোটেই ওয়েলকামড ছিল না। ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর মহাসন্দর্ভ ‘ম্যাডনেস অ্যান্ড সিভিলাইজেশন’-এ যেমন বলা হয়েছিল, মধ্যযুগেও ইওরোপে মানসিক প্রতিবন্ধী তথা উন্মাদদের সমাজে একটা স্থান ছিলই। তাদের আলাদা করে খাঁচায় পোরার রীত-রেওয়াজ তখন ছিল না। এই পৃথগায়ন আর বিচ্ছিন্নকরণ শুরু হয় ১৮ শতকের জ্ঞানদীপ্তির কালে, যুক্তিবাদের উন্মেষের সময়ে। এই সূত্রে এ কথা কি বলা যায়, আমাদের দেশে বডি শেমিংয়ের কালচারটিও ওই যুক্তিবাদেরই অবদান, যেখানে মানব শরীরকে একটা বিশেষ ‘আদর্শে’ দেখতেই অভ্যস্ত করে তোলা হচ্ছে সমাজকে? বৈচিত্র বা বিভন্নতার স্থান ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে! ১৯ শতকে আকারে ছোট মানুষদের স্থান হতে শুরু করে সার্কাসে। যা মূলত এক পশ্চিমি আধুনিক প্রদর্শন। সেখানে খর্বকায় মানুষের উপস্থিতি মূলত ভাঁড় হিসেবে, কৌতুকের উপাদান হিসেবে। মধ্যযুগে ইওরোপের সামন্তসভা বা রাজসভায় ‘জেস্টার’ হিসেবে শারীরিক অসঙ্গতিসম্পন্ন মানুষের উপস্থিতি ছিল। কিন্তু তাদের অনেক সময়েই দেখা গিয়েছে ‘মহাজ্ঞানী’ হিসেবে। রাজা বা সামন্তপ্রভু তাদের কাছে পরামর্শ নিয়েছেন সঙ্কটকালে। এই দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে যায় ১৮-১৯ শতকে। পুরুষের চেহারার আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করা হয় পেশল দেহকে, নারীর আদর্শ শরীর হিসেবে তুলে ধরা হয় ‘আওয়ার গ্লাস’ ফিগারকে। সেই ট্র্যাডিশন থেকে আজও বেরতে পারেনি পশ্চিম এবং একদা পশ্চিম দ্বারা বিজিত ও শাসিত প্রাচ্য।
আরও পড়ুন: বডি শেমিংয়ের শিকার এই মহিলা এখন মিস চেন্নাই
কতটা পথ পেরোলে তবে মানুষ সে মানুষ হবে...। ছবি: শাটার স্টক।
আদর্শ সমাজের আদর্শ চেহারার এক ধাঁচা আমাদের মস্তিষ্কে গজাল মেরে ঢোকানো হয়। ১৯ শতকে আমাদের সোশ্যাল রিফর্মের অন্যতম অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছিল শরীরচর্চা, এ কথা ভুলে গেলে চলবে না। সেই শরীর থেকে আজকের সিক্স প্যাক খুব দূরে নয়। এই তো ক’দিন আগেই ফেসবুকে জনৈক শিল্পীর আঁকা শিব নিয়ে তুলকালাম হয়ে গেল। শিল্পী সওয়াল করেছিলেন বাংলার সনাতনি ভাঙড়-ভোলা মহাদেবের সপক্ষে। উত্তর ভারত থেকে আমদানি করা সিক্স প্যাক শিবের থেকে যিনি একেবারেই আলাদা। বাংলার শিব স্ফীতোদর, আধবুড়ো, দোজবরে ভোলানাথ। জিমখানার কসরৎ থেকে তিনি বহু দূরের লোক। তাঁকে কুঁড়ে বলে, ‘নির্গুণ’ (এ শব্দের আলাদা আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনা রয়েছে) বলে অন্নদা ঠেস দিতে পারেন, কিন্তু ভক্ত পারে না। তার কাছে তিনি কাছের মানুষ। তাঁকে তো গ্রামপ্রান্তেই দেখা যায়! সেই শিব কী করে আমিশ ত্রিপাঠীর ‘শিভা ট্রিলজি’-র পেশল হিরো হয়ে ওঠেন, তা বুঝতে গেলে রাজনীতির এক গোলকধাঁধায় পাক খেতে হবে, যেখানে উপনিবেশের উত্তরাধিকার নব্য হিন্দুত্ববাদের কান ধরে টানে। নব্য হিন্দুত্ববাদ ফেলে আসা উপনিবেশের দেনা চোকায় তার উগ্র সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে।
ন্যাকিম গেটউইচ। বডি শেমিংয়ের শিকার এই মেয়ে এখন বিশ্বের অন্যতম সেরা মডেল।
গত পাঁচ-সাত বছরে অবশ্য অবস্থার কিঞ্চিৎ উন্নতি ঘটেছে। ‘বডি শেমিং’ শব্দটি অন্তত সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণেই আমাদের ঘরে ঢুকে পড়েছে। ১৯৮০-র দশকেও একটু মোটা চেহারার কিশোরটি বুলিড হত বন্ধু সমাজে, তার প্রেমিকা জোটা অসম্ভব ছিল এই বাংলায়। সেখানে আজ ওবেসিটিকে অসুখ হিসেবে দেখা হলেও, তার সঙ্গে মেলামেশার বাধো-ভাব দূর হয়েছে। ‘বেঁটে’ বা ‘মোটা’ বলে প্যাঁক দেওয়ার রেওয়াজও কমেছে। কিন্তু সর্বত্রই কি কমেছে? সমাজের এমন অনেক কোণ রয়ে গিয়েছে, যেখানে কোয়াডেনের ঘটনা দেশ-কাল নিরপেক্ষ ভাবে অভিনীত হয়ে চলে। পাত্রী চাই-এর বিজ্ঞাপনে আজও ‘ফরসা, স্লিম’ পাত্রী চেয়ে হাঁক পাড়া হয়। স্বল্পকেশ অল্পবয়সি ছেলের পাত্রী জোটা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে এর বিরুদ্ধে জেহাদ শুরু হয়েছে। বলিউডের মেন স্ট্রিম থেকেই উঠে এসেছে ‘দম লাগাকে হেঁইসা’ বা ‘বালা’-র মতো ছবি। কিন্তু তবু, কোয়াডেনের ঘটনা ঘটে। ঘটে চলে। যেমন, দাঙ্গা খারাপ জেনেও তা ঘটে যায়, সে ভাবেই মৃদু হিংসার এক প্রবাহ ফল্গুস্রোতের মতো বইতে থাকে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় কোয়াডেনদের। তখন হয় সে মরতে চায়, নয় মারতে চায়। শুরু করতে চায় পাল্টা হিংসার খেলা।