প্রজ্ঞা সিংহ ঠাকুরের মন্তব্যটি যে ‘ব্যক্তিগত’, তাহাতে সন্দেহ কী? কিন্তু, এই সাধ্বীর ‘ব্যক্তি’টি ভারতীয় জনতা পার্টি নামক দলের। দিনকয়েক পূর্বেই সেই ‘ব্যক্তি’কে বরণ করিয়া লইয়াছে বিজেপি। মালেগাঁও বিস্ফোরণের অন্যতম অভিযুক্ত, দীর্ঘ দিন জেল হেফাজতে থাকা সাধ্বীকে ভোপাল লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী করিয়াছে। এবং, নিন্দকের মুখে জাতীয়তাবাদ দিয়া প্রধানমন্ত্রী জানাইয়াছেন, যাহারা সুপ্রাচীন ভারতীয় সভ্যতাকে অপমান করে, প্রজ্ঞা সিংহ ঠাকুরের প্রার্থিপদ তাহাদের সমুচিত জবাব। অর্থাৎ, প্রজ্ঞা সিংহ ঠাকুরকে লইয়া বিজেপির অস্বস্তি ছিল না। অহঙ্কারই ছিল সম্ভবত। মুম্বই হামলায় নিহত, অশোকচক্র-সম্মানিত হেমন্ত কারকারে বিষয়ক মন্তব্যটি লইয়াই সমস্যা। স্বাভাবিক। যাহারা জাতীয়তাবাদকে প্রায় দলীয় সম্পত্তি ভাবিয়া বসিয়াছে, যাহাদের শীর্ষ নেতারা নির্বাচন কমিশনের আদেশ অবজ্ঞা করিয়া, ভূতপূর্ব সেনানীদের আপত্তি উড়াইয়া একের পর এক নির্বাচনী জনসভায় শহিদ সৈনিকদের প্রসঙ্গ টানিয়া আনিতেছেন, সেই দলের কোনও প্রার্থী মুম্বই জঙ্গিহানায় শহিদ হেমন্ত কারকারে সম্বন্ধে অবমাননাকর মন্তব্য করিলে দলের পক্ষে তাহা হজম করা মুশকিল। অতএব, সেই মন্তব্যটি ‘ব্যক্তিগত’ হিসাবে চিহ্নিত করিয়া, প্রজ্ঞাকে দিয়া মন্তব্য প্রত্যাহার করাইয়া বিজেপি দায় ঝাড়িতে ব্যস্ত।
কিন্তু, অতই কি সহজ? দল যে ব্যক্তিকে আগাপাছতলা গ্রহণ করিয়াছে, তাহার ‘ব্যক্তিগত’ মন্তব্যের দায়ও দলকে বহন করিতে হইবে, ইহা যদি এক দিক হয়, তবে অন্য দিকে আছে সৈনিক অথবা শহিদদের বিষয়ে দলের প্রকৃত অবস্থান। সেনার রাজনৈতিক ব্যবহার বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্তাদের আপত্তিকে বিজেপি যে ভাবে খাটো করিবার চেষ্টা করিয়াছে, অথবা ‘সিয়াচেনের সৈনিক’দের প্রকৃত প্রস্তাবে যে দুরবস্থায় থাকিতে বাধ্য করিয়াছে, তাহাতে স্পষ্ট, দলের নিকট সেনা বা শহিদরা নেহাতই রাজনৈতিক মশলা। নরেন্দ্র মোদী তাঁহাদের এক ভাবে ব্যবহার করেন, প্রজ্ঞা ঠাকুর আর এক ভাবে। যাঁহার রাজনীতিতে যে মশলার প্রয়োজন। শহিদদের সিংহাসনে বসাইলে মোদীর সুবিধা, অপমান করিতে পারিলে প্রজ্ঞার। তাঁহারা ছকে ভুল করেন নাই।
বৃহত্তর প্রশ্নটি অন্যত্র। হেমন্ত কারকারে বিষয়ে প্রজ্ঞা সিংহ ঠাকুর কী মনোভাব পোষণ করিতে পারেন, তাহা অনুমান করা দুরূহ নহে। এক জন সৎ, নির্ভীক পুলিশ অফিসার ও কোনও এক অভিযুক্ত সন্ত্রাসবাদীর সম্পর্ক যে তারে বাঁধা থাকিবার কথা, এই দুই জনের সম্পর্কও তাহার ব্যতিক্রম ছিল না। প্রজ্ঞা সিংহদের সহিত হেমন্ত কারকারেদের শত্রুতা থাকাই স্বাভাবিক। এক্ষণে প্রশ্ন, যে দল জনসমক্ষে নিরন্তর কারকারেদের ন্যায় শহিদদের মাহাত্ম্যকীর্তন করিয়া চলে, সেই দলে প্রজ্ঞা সিংহ ঠাকুরদের ঠাঁই হয় কী ভাবে? কোনও যুক্তিতেই এই ‘বিরোধ’টির সমাধান সম্ভব নয়। যে ভঙ্গিতে মোদী সাধ্বী প্রজ্ঞাকে দলে স্বাগত জানাইয়াছেন, এবং যে ভঙ্গিতে প্রকৃত শহিদদের শুধুই রাজনৈতিক আয়ুধ হিসাবে ব্যবহার করিয়া চলিয়াছেন, তাহাতে বোঝা যায় তাঁহার ও দলের মন কোথায়। জাতীয়তাবাদ, দেশের নিরাপত্তা ইত্যাদি কথা শুধু জনসভা গরম করিবার জন্য, ইস্তাহারের পাতা ভরাইবার জন্য— উগ্র হিন্দুত্ব ব্যতীত আর কিছুতে তাঁহাদের মন নাই। যোগী আদিত্যনাথ হইতে সাক্ষী মহারাজ, গিরিরাজ সিংহ হইতে নিরঞ্জন জ্যোতি বা মহেশ শর্মা— বিজেপির প্রথম বা দ্বিতীয় সারিতে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের প্রবল উপস্থিতিই বলিয়া দেয়, তাঁহারা কোন ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। সেই ভারত হেমন্ত কারকারের নহে, পুলওয়ামার শহিদদের নহে। অতএব, সাধ্বীর মন্তব্য হইতে দূরত্ব বাড়াইবার প্রয়োজন কী? বিজেপি নেতারা বরং বুক ঠুকিয়া বলুন, এখনও যাঁহারা ধর্মনিরপেক্ষ, উদারবাদী ভারতের স্বপ্ন দেখেন, সাধ্বী তাঁহাদের সেই স্বপ্নের সমুচিত জবাব।