প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দ্বিতীয় দফার সরকারে বিদেশ দফতরের ভার যাঁহার হাতে, সেই সুব্রাহ্মণ্যম্ জয়শঙ্কর প্রত্যক্ষ রাজনীতির লোক নহেন। বিদেশ সচিব হিসাবে দক্ষতার পরিচয় দিয়াছিলেন বলিয়াই তাঁহার মন্ত্রিত্বে ঈষৎ অপ্রত্যাশিত অভিষেক। মন্ত্রী হিসাবে প্রথম পদক্ষেপেই আবারও তাঁহার দক্ষতার পরিচয় মিলিল, যখন তিনি ‘প্রতিবেশী নীতি’ দিয়া কাজ শুরু করিলেন। এক ‘উদার’ নীতির কথা বলিলেন তিনি, যেখানে প্রতিবেশীর সহিত আদানপ্রদান তুল্যমূল্য বিচারে ওজন করিয়া না দেখিয়া একটি বৃহত্তর সহযোগিতার আবহ তৈরির চেষ্টা করা হইবে। ভারতের অর্থনৈতিক পরিবেশ হইতে যাহাতে অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ উপকৃত হয়, তাহার দিকে লক্ষ্য থাকিবে। এই সংযোগরক্ষা বা ‘কানেকটিভিটি’ই আপাতত ভারতের প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত, তিনি মনে করিয়াছেন। অত্যন্ত সময়োচিত এই উপলব্ধি, এবং স্বাগত। বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতেও যে দক্ষিণ এশিয়া এখনও যথেষ্ট ‘সংযুক্ত’ নয়, এখনও যে তাহার অনেক পথ যাইতে বাকি, এমনকি নিকট প্রতিবেশী দেশগুলির সহিতও সম্পর্ক উন্নয়নের বহু পথ এখনও পরখ করিয়াই দেখা হয় নাই, তাহা নূতন করিয়া বলিবার দরকার নাই। জয়শঙ্কর উবাচ: আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্কে গতি আনিবার জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘ইনসেনটিভ’ বা প্রণোদনা দিবার দরকার থাকিলেও ভারতের দিক হইতে ‘ওভার-নেগোশিয়েট’ অর্থাৎ বাড়াবাড়ি রকমের দর-কষাকষির দরকার নাই। ক্রমশই যে বিশ্বে দেশগুলি আপন আপন সঙ্কীর্ণ গন্ডিতে আরও বেশি করিয়া আবদ্ধ হইয়া পড়িতেছে, তেমন একটি গ্রহে দাঁড়াইয়া ভারতের নূতন বিদেশমন্ত্রীকে অভিনন্দন, এমন একটি কথা বলিবার জন্য! আশা থাকিল, এমন এক উদার প্রতিবেশী নীতি আগামী পাঁচ বৎসরে দেখা যাইবে।
উল্লেখ্য, এই প্রসঙ্গে বিদেশমন্ত্রী ‘বিমস্টেক’ নামে আন্তর্জাতিক মঞ্চটির উপর বিশেষ ভরসা রাখিয়াছেন। ‘বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকনমিক কোঅপারেশন’ মঞ্চটি আপাতত উদ্দীপনায় টইটম্বুর— মন্ত্রীর বক্তব্য। যেহেতু এই মঞ্চের নেতাদের সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী-সহ মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণের দিনও অতিথি আসনে দেখা গিয়াছে, ধরিয়া লওয়া যায় এখন এই দিকে মন্ত্রকের মনোযোগ নিবদ্ধ হইবে। সার্ক-এর সহিত তুলনাসাপেক্ষেই ‘উদ্দীপনা’ শব্দটি উঠিয়াছে। নানা কারণে সার্ক-এর আলোচনা ও কর্মকাণ্ডের পথ সমানেই রুদ্ধ হইয়া যায়— মন্ত্রীর মত। বুঝিতে কষ্ট হয় না, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কই এখানে সেই অনুচ্চারিত প্রতিরোধক শক্তি— মন্ত্রীর ভাষায়, যে শক্তি সন্ত্রাসের বিষয়টি ছাড়িয়া দিলেও সংযোগ ও বাণিজ্যের মতো ক্ষেত্রে নিয়মিত অনুভূত হয়। অর্থাৎ বিমস্টেক-এ পাকিস্তানের অনুপস্থিতিই তাহার ‘উদ্দীপনা’র অন্যতম কারণ, প্রকারান্তরে তাহা স্বীকার করা হইয়াছে।
ইহা নিতান্ত অনস্বীকার্য বাস্তব। অপ্রিয় বাস্তবও বটে। তবু বাস্তব বাস্তবই, সুতরাং যদি ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথের পাশ কাটাইয়া কোনও প্রয়োগমুখী কূটনীতি ভারতের সহিত তাহার অন্যান্য প্রতিবেশীর সম্পর্ক উন্নত করিতে পারে, তাহাতে মস্ত বড় লাভ। তবে কি না, পাকিস্তানের সহিত সম্পর্ককেও একেবারে ফেলনা করিয়া রাখা যাইবে না। নরেন্দ্র মোদীর গত প্রধানমন্ত্রিত্বকালে ইসলামাবাদের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক ক্রমাগত মন্দ হইয়াছে, কাশ্মীর ও সন্ত্রাস প্রসঙ্গটি আর সব বিষয়কে গ্রাস করিতে উদ্যত হইয়াছে। সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনের সময় দুই দেশের সম্পর্ক আরও খানিক অবনমিত হইয়াছে। এই নিম্নমুখী যাত্রা হইতে পাকিস্তানের সম্পর্ককে তুলিয়া আনা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আশা থাকিল, নূতন বিদেশমন্ত্রক এই দিকেও যথোচিত মন দিবেন, বহুপাক্ষিক মঞ্চে সম্ভব না হইলে দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই। দক্ষিণ এশিয়ার স্বাস্থ্যের জন্য ইহাও কম জরুরি নহে।