জয়োদ্দীপ্ত: এনডিএ-র জয়ের খবরে রাস্তায় নেমে এসেছেন দলের সমর্থকরা, পটনা, ১১ নভেম্বর। পিটিআই
গত জুন মাসের সাত তারিখ। দেশের মানুষ তখনও লকডাউনের বন্দিদশার ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেননি। অমিত শাহ দিল্লি থেকেই ‘বিহার জন সংবাদ’ নামে ভার্চুয়াল সভা করলেন। এবং বললেন, বিহারে এখন আর ‘জঙ্গলরাজ’ চলে না। এনডিএ সরকারের আমলে ‘জনতারাজ’ চলে।
২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগের বছরে বিজেপি তিন রাজ্যে ক্ষমতা হারিয়েছিল। মধ্যপ্রদেশ-রাজস্থান-ছত্তীসগঢ়, তার আগে কর্নাটক, ২০১৮ থেকে গত দু’বছরে বিজেপি ৮টি রাজ্যের বিধানসভা ভোটে হেরেছে। হরিয়ানার মতো রাজ্যে হয়তো হেরে গিয়েও সরকার গড়েছে। মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটকে হেরে গিয়েও আবার শাসক দলের বিধায়ক ভাঙিয়ে ক্ষমতায় ফিরেছে। কিন্তু তাতে গত দু’বছরে বিজেপির ৮টি বিধানসভা ভোট এবং ২১৮টি বিধানসভা উপনির্বাচনে হারের ট্র্যাকরেকর্ড বদলায়নি। অথচ এরই মধ্যে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের বিজেপি ৩০৩ আসনে জিতে কেন্দ্রে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখল করেছে।
প্রশ্নটা তাই উঠেছিল, ‘মোদী-ম্যাজিক’ কি রাজ্য রাজনীতিতে কাজ করে না? রাজ্যের ভোটে কি আঞ্চলিক দলের তুলনায় বিজেপির শক্তি, স্থানীয় মানুষের চাওয়া-পাওয়া, রাজ্যের বিজেপি সরকারের প্রতি মানুষের মনোভাবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে? রাজ্যের ভোটে কি অমিত শাহের চাল কেরামতি দেখাতে পারে না? তাঁর কার্যকারিতা কি শুধু অন্য দল ভাঙিয়ে বিজেপির সরকার গড়াতেই সীমাবদ্ধ?
বিজেপির ‘চাণক্য’ এ বার সশরীরে বিহারের ভোটের ময়দানে নামেননি। হয়তো করোনা থেকে সেরে ওঠার পরে স্বাভাবিক শারীরিক দুর্বলতার জন্য। কিন্তু অক্টোবর-নভেম্বরে বিহারের ভোটের জন্য জুন মাসেই তিনি যে ভাবে গোটা দলকে মাঠে নামিয়ে দিয়েছিলেন, তাতে একটা কথা স্পষ্ট ছিল। ‘মোদী-ম্যাজিক’ ও ‘শাহ-স্ট্র্যাটেজি’-র ‘গ্যারান্টি পিরিয়ড’ যে এখনও ফুরোয়নি, তা প্রমাণে বিজেপি এ বার বিহারের ভোটে জিততে মরিয়া।
কান ঘেঁষে হলেও বিজেপির হাত ধরেই এনডিএ-র বিহার জয় প্রমাণ করল, ‘মোদী ম্যাজিক’ এখনও রাজ্যের রাজনীতিতে ফসল কুড়োচ্ছে। কোভিড অতিমারির পরে গোটা দেশে বিহারেই প্রথম ভোট হল। কোভিড মোকাবিলায় ব্যর্থতা, পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা, অর্থনীতির বেহাল দশা থেকে চিনের জমি দখল— সব তির সামলেই বিহারে এক ডজন জনসভা করেছেন নরেন্দ্র মোদী। নীতীশ কুমারের ১৫ বছরের রাজত্বের পর স্বাভাবিক নিয়মে তৈরি হওয়া ক্ষোভ, প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার হতাশাও সামলাতে হয়েছে তাঁকে। গুজরাত-উত্তরপ্রদেশের মতো বিহারে পাকিস্তান-সিএএ-কাশ্মীর-রামমন্দিরের নামে ভোটের মেরুকরণ হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও যেখানেই প্রচারে গিয়েছেন মোদী, সেখানেই বিজেপি-জেডিইউ জোটের জন্য ভোট কুড়িয়েছেন। বিজেপি নেতারা বলছেন এবং আগামী দিনেও বলবেন, এ হল নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর গরিবদরদি সরকারের সাফল্য। লকডাউনের পরে গরিব কল্যাণ যোজনায় বিনা মূল্যে অন্ন জোগানোর সাফল্য। বিহারের সঙ্গে দেশের উন্নয়নে মোদীর ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর সাফল্য।
বাস্তবে, এ হল ‘মোদী-নির্ভর বিজেপি’-র সাফল্য। নরেন্দ্র মোদীকে বিজেপি কখনও জনকল্যাণের ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে ব্যবহার করবে, কখনও জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেমের আবেগ উস্কে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করবে। কখনও তিনি বিজেপির জন্য ভোটের মেরুকরণ করবেন। আবার তিনিই আর্থিক বৃদ্ধি, উন্নয়ন থেকে আধুনিক ভারতের পথপ্রদর্শক অবতারে উত্তীর্ণ হবেন। বোধ হয় সে কারণেই অমিত শাহ বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘‘নরেন্দ্র মোদীকে একটা সুযোগ দিন। পাঁচ বছরে সোনার বাংলা গড়ে দেব।’’ দিলীপ ঘোষ বা মুকুল রায় নয়, সোনার বাংলার দায়িত্বও মোদীরই কাঁধে। মোদীই সব। মোদী বিনে গতি নেই।
এই উত্তরোত্তর ‘মোদী-নির্ভরতা’ হয়তো এখনই বিজেপিকে আত্মসমীক্ষায় বাধ্য করছে না। কিন্তু বিহারের ভোট আরও এক বার কংগ্রেসকে আত্মসমীক্ষার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। জাতীয় স্তরে সনিয়া-রাহুল গাঁধীর কংগ্রেস নরেন্দ্র মোদীর বিজেপির ধারেকাছেও নেই। তার থেকেও চিন্তার কারণ হল, রাজ্যওয়াড়ি জোটে কংগ্রেস দিনে দিনে শরিক আঞ্চলিক দলের গলগ্রহ হয়ে উঠছে। বিহারে যদি কোনও দল হেরে থাকে, সেটা কংগ্রেস। উত্তরপ্রদেশে এসপি, মহারাষ্ট্রে এনসিপি, ঝাড়খণ্ডে হেমন্ত সোরেনের ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা, এ বার বিহারে তেজস্বী যাদব— শরিক আঞ্চলিক দলকে টেনে তোলার বদলে, বোঝা হয়ে তাদের টেনে নামাচ্ছে কংগ্রেস। বিহারে ৭০ আসনে লড়ে ৩০ শতাংশ আসনও কংগ্রেস জিততে পারেনি। কংগ্রেসের খারাপ ফলের জন্যই সর্ববৃহৎ দলের নেতা হয়েও তেজস্বী যাদবের মুখ্যমন্ত্রীর আসন অধরা থেকে গেল। আগামী বছর তামিলনাড়ুর ভোট। কংগ্রেসের শরিক ডিএমকে-র এম কে স্ট্যালিনকে নিশ্চিত ভাবেই এ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে হবে। কারণ গত বিধানসভায় কংগ্রেসের খারাপ ফলের জন্যই স্ট্যালিন এডিএমকে-কে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর গদি দখল করতে পারেননি।
বিহার বাদে হিন্দি বলয়ের উপনির্বাচনেও কংগ্রেসের ভরাডুবি। উত্তরপ্রদেশে দু’টি বিধানসভা কেন্দ্র— বুলন্দশহর, নওগাঁওয়া সাদাতের উপনির্বাচনে কংগ্রেস চতুর্থ স্থানে। বুলন্দশহরে কোনও এক আজাদ সমাজ পার্টির থেকেও কংগ্রেস কম ভোট পেয়েছে। রাহুল গাঁধী, প্রিয়ঙ্কা বঢরার জুটি হাথরসের দলিত পরিবারের সঙ্গে দেখা করার জন্য রাস্তায় নেমেছিলেন। কিন্তু তার পরে তাঁরা অদৃশ্য। রাহুল বিহারে মাত্র আটটি জনসভা করেছেন। সত্তরে পা দেওয়া নরেন্দ্র মোদীও তাঁর থেকে বেশি জনসভা করেছেন। প্রিয়ঙ্কাকে বিহার তো দূর, তাঁর নিজের রাজ্য উত্তরপ্রদেশেই দেখা যায়নি। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ, রাহুল-প্রিয়ঙ্কার ভাইবোনের জুটির ‘এই আছি, এই নেই’ রাজনীতির সঙ্গে মাটির কোনও সম্পর্ক রয়েছে বলেই মানুষ এখনও মনে করছেন না।
এই শিকড়ের অভাবেই রাহুল-প্রিয়ঙ্কা পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা, রুটিরুজি নিয়ে নিয়মিত টুইট করে গেলেও কংগ্রেসের ঝুলিতে ভোট টেনে আনতে পারেননি। অথচ একই হাতিয়ার নিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থেকে সিপিআই-এমএল সাফল্য কুড়িয়েছে। মোদ্দা কথা হল, নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে যখন রাজ্য স্তরে অশোক গহলৌত, ভূপেশ বাঘেল, ক্যাপ্টেন অমরেন্দ্র সিংহের মতো নেতারা রুখে দাঁড়াচ্ছেন, কংগ্রেস সাফল্য পাচ্ছে। বিহারে কংগ্রেসের তেমন কেউ ছিলেন না। মানুষ যখন নরেন্দ্র মোদীর উল্টো দিকে রাহুল গাঁধীকে দেখেছেন, তখন হাত-এর বদলে কমল-এ ভোট পড়েছে। ভোটের ফলপ্রকাশের আগেই ইভিএম নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়ে রাহুল গাঁধী আসলে নিজের হার স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
বিহারের ভোট জিততে মরিয়া হলেও মোদী-শাহ জুটি কিছুটা ঝুঁকিও নিয়েছিলেন। মহারাষ্ট্রে শিবসেনার সঙ্গে জোটে বিজেপি ছোট শরিক থেকে এক সময় নিজেই বড় শরিক হয়ে উঠেছিল। পঞ্জাবে শিরোমণি অকালি দলের সঙ্গে জোটেও বিজেপি একই চেষ্টা শুরু করেছিল। দুই রাজ্যেই শরিকদের সঙ্গে বিচ্ছেদের পরে বিহারেও প্রধান দল হিসেবে উঠে আসা বিজেপি নেতৃত্বের লক্ষ্য ছিল। সে কাজেও অমিত শাহ সফল। নীতীশ কুমারের ভোট কাটতে যে চিরাগ পাসোয়ানকে নামানো হয়েছিল, তা জেডিইউ নেতারা আগেই টের পেয়েছিলেন। শঙ্কা সত্যি করেই জেডিইউ-এর আসন কমেছে। কিন্তু তাতে এনডিএ-র ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ঝুঁকি ছিল। উল্টো দিকে আরজেডি-র আসন কমাতে বিজেপি আসাদুদ্দিন ওয়েইসিকে নামিয়েছিল বলেও অভিযোগ। এই রাজনৈতিক জুয়াখেলাতেও অমিত শাহ বাজিমাত করেছেন। আপাতত নীতীশ কুমার মুখ্যমন্ত্রী হলেও, আজ না হলে আগামী দিনে বিহারের গদি বিজেপির দখলে আসবেই।
রাহুল গাঁধীর মতো তেজস্বী যাদবেরও এই ভোট থেকে একটাই শিক্ষা নেওয়ার। তা হল, শুধু নেতিবাচক ভোটের ভরসায় থেকে, মোদী বা নীতীশ সরকারের উপর ক্ষুব্ধ মানুষের ভোটের ভরসায় নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়া যায় না। আমজনতার সম্পূর্ণ আস্থা অর্জনও জরুরি। তেজস্বী অনেকটাই পেরেছেন। রাহুল গাঁধী এখনও শুরুর রেখায়।