খাজুরডিহি গ্রামে হরিসাগর। নিজস্ব চিত্র
মধ্যযুগের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সে সময়ে শিক্ষিত ও বহু ভাষা জানা মানুষদের প্রধান গন্তব্য ছিল দিল্লি। সেখানে রাজার অনুগ্রহ প্রার্থী হতেন তাঁরা। আর কোনও ভাবে একটি চাকরি পেলেই কৃতার্থ হতেন তাঁরা। আবার দিল্লিতে যেতে না পারলে অনেকে বাংলার নবাবের দরবারে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিতেন। নানা ভাষা জানার সুবাদে নবাবদের কাছে এই ধরনের কর্মচারীর বিশেষ কদর ছিল। অনেক সময়ই রাজস্ব আদায়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব এই ধরনের মানুষের উপরে ন্যস্ত হত। সম্রাট আলাউদ্দিন হোসেন শাহের সময় এমনই দু’জন ব্যক্তি ছিলেন দবীর খাস এবং সাখর মল্লিক। পরে শ্রীচৈতন্যের টানে তাঁরা বৈষ্ণব আন্দোলনে যোগ দেন। দিল্লিতে আকবরের শাসনকালে এমনই এক ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন তাঁর অর্থ ও আইনমন্ত্রী টোডরমলের ভরসার প্রধানকেন্দ্র। তাঁর নাম ছিল ভগবানচন্দ্র রায়। তিনি ছিলেন, বাংলা-বিহার-ওড়িশার ‘প্রথম কানুনগো’। কাটোয়ার খাজুরডিহি গ্রামে এই ‘বঙ্গধিকারী’-র বসবাস ছিল।
টোডরমল বা তোদরমলের নাম আমাদের সকলেরই জানা। তিনি ছিলেন সম্রাট আকবরের বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন কর্মচারীদের মধ্যে এক জন। প্রথম জীবনে শেরশাহের কাছে কাজ করলেও পরে শাসনক্ষমতার হস্তান্তরের পরে আকবর তাঁকে বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বহাল করেন। আকবর তাঁর উপরে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেন। প্রথম জীবনে আগ্রা, পরে বাংলার ও পঞ্জাবের মতো এলাকায় টোডরমল শাসক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৫৮২ সালে তিনি বাংলার জমিদারদের থেকে রাজস্ব নেওয়ার রীতি প্রচলন করেন।
এর পরে রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত নিয়মাবলী ও ব্যবস্থার সংস্কার ও পুনর্গঠন শুরু হয়।
শাসনযন্ত্রকে সংস্কার ও তাকে কার্যকরী করার বিষয়ে টোডরমলের দক্ষতার প্রশংসা করেছেন অনেক ইতিহাসবিদই। টোডরমল দায়িত্ব নেওয়ার পরেই রাজস্ব আদায় ও তার ঠিক হিসেব রাখার জন্য একাধিক ‘কানুনগো’ নিয়োগ করেন। এঁদের উপরে এক জন প্রধান কানুনগো থাকতেন। তিনি বাংলা-বিহার-ওড়িশার দায়িত্ব সামলাতেন। কাটোয়ার খাজুরডিহি গ্রামের সন্তান ভগবানচন্দ্র রায়কে তিনি বাংলা, বিহার, ওড়িশার প্রধান কানুনগো হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন।
পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়া মহকুমার খাজুরডিহি গ্রামের সন্তান ভগবানচন্দ্র মিত্র ছিলেন উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থ। আকবরের রাজসভায় এক জন কর্মচারী হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। গবেষকদের একাংশের দাবি, দিল্লিতে থাকার সময়েই ভগবানচন্দ্র, টোডরমলের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। তাই সম্রাট আকবর তাঁকে প্রধান কানুনগো পদে নিযুক্ত করেন এবং ‘রায়’ উপাধিতে ভূষিত করেন। টোডরমল বাংলার দায়িত্ব নেওয়ার পরে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থার সংস্কার করেন এবং এই সময়ে রাজস্ব আদায়ের জন্য তিনি কাছে ডেকে নেন একান্ত বিশ্বাসভাজন ভগবানচন্দ্র রায়কে। নিখিলনাথ রায়ের মতো কিছু গবেষক অবশ্য মনে করেন, ভগবানচন্দ্রের বংশধরেরা ‘রায়’ উপাধি পান শাহ সুজা শাসনকর্তা হওয়ার পরে।
ভগবানচন্দ্রের পরের প্রজন্মও বাংলার রাজস্ব আদায়-সহ একাধিক প্রশাসনিক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই প্রথম জীবনে কাটোয়ার খাজুরডিহিতে থাকতেন। এই গ্রামের একাধিক গঠনমূলক কাজের সঙ্গে ভগবানচন্দ্র ও তাঁর বংশধরেরা নিযুক্ত ছিলেন। তাঁদের বংশ থেকে পাওয়া নথি অনুসারে, ১৬৭৯ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেব এক ফরমান জারি করে ভগবানচন্দ্র রায়ের পুত্র হরিনারায়ণ রায়কে অর্ধেক সুবার ‘প্রধান কানুনগো’ হিসেবে নিযুক্ত করেন। হরিনারায়ণের পুত্র দর্পনারায়ণ রায় ১৭০৪ সালে ‘বঙ্গাধিকারি’ হলেন। তখন আজিম উস-শান ছিলেন বাংলার নবাব। হিজরি ১১৩৭ সালে দিল্লির সম্রাট মোহম্মদ শাহের ফরমান বলে দর্পনারায়ণের পুত্র শিবনারায়ণ রুকনপুরের জমিদারি লাভ করেন। আলীবর্দী খাঁ বাংলার নবাব হলে শিবনারায়ণের পুত্র লক্ষীনারায়ণ ‘বঙ্গাধিকারী’-র পদ পান। ১৭৫৭ সালে ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজউদ্দৌলার যে সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় তাতে সাক্ষী হিসাবে শিবনারায়ণ রায়ের পুত্র লক্ষ্মীনারায়ণের নাম পাওয়া যায়। লক্ষ্মীনারায়ণ রুকুনপুর ও সদ্বীপ প্রভৃতি অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে ব্রহ্মত্তর সম্পত্তি রেখে গিয়েছে। তাঁর পুত্র সূর্যনারায়ণ রায়ের সময় থেকে ‘বঙ্গাধিকারি’ পদের আর কোনও গুরুত্ব ছিল না। সূর্যনারায়ণের পুত্র প্রতাপনারায়ণ রায়ের সময় দৈন্যদশা চরমে পৌঁছলে তিনি ইংরেজ সরকারের সাব-রেজিস্ট্রার পদে নিযুক্ত হন।
বংশ পরম্পরায় বাংলার রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও কাটোয়ার খাজুরডিহি ও তৎলগ্ন এলাকার নানা গঠনমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এই বংশের পুরুষেরা। গবেষকেরা মনে করেন, বাংলার রাজধানী কিছুদিনের জন্য ঢাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার সময়ে এই বংশের পুরুষেরাও ঢাকায় গিয়েছিলেন। মুর্শিদাবাদের ডাহাপাড়ায় এই বংশের উত্তরপুরুষ প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন বলে কথিত রয়েছে। ডাহাপাড়া গ্রামে বারদুয়ারি প্রাসাদে পুকুর ও ভুবনেশ্বরী দেবীর মন্দির তৈরি করেন এই পরিবারের সদস্যেরা। পরে সেখান থেকে সরে এসে সাইকুল এলাকায় রাজবাড়ি নির্মাণ করেন পরের প্রজন্ম। ভগবান রায়ের পুত্র হরিনারায়ণ রায় খাজুরডিহি গ্রামে পশ্চিম প্রান্তে একটি দিঘি খনন করেন সেটি ‘হরি সাগর’ নামে পরিচিত। ক্ষীরগ্রামের যোগাদ্যা দেবীর সেবায় ১,৬০০বিঘে জমি দান করেন তিনি। কাটোয়ার মাধাইতলা আশ্রমকেও সম্পত্তি দান করেন হরিনারায়ণের পুত্র। দর্পনারায়ণ রায় মুর্শিদাবাদে কিরীটেশ্বরী মন্দির সংস্কার করেন। খাজুরডিহিতে ‘কালি সাগর’ দিঘি তৈরি করেন। শিবনারায়ণ রায়ের পুত্র লক্ষীনারায়ণ রুকুনপুর ও সদ্বীপ প্রভৃতি অঞ্চলে ব্রহ্মত্তর সম্পত্তি রেখে গিয়েছেন।
কাটোয়া শহর থেকে দু’কিলোমিটার দূরে থাকা এই গ্রাম আজও হরিসাগর, কালীসাগর, ভৈরবনাথ মন্দির, সুবিক্ষাদেবীর মন্দির, শিবমন্দির, রক্ষাকালী বেদির মতো স্থান ও তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ইতিহাসকে সম্বল করে এগিয়ে চলেছে আধুনিকতার পথে।