Bengali New Year

নতুন বছরে জাগুক নতুন উপলব্ধি

অশান্তি ও বিভাজন— তাও সয়েছে বাংলা।

Advertisement

তিলোত্তমা মজুমদার

শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২০ ০৬:০০
Share:

এমন নববর্ষ কখনও আসেনি আগে। বাংলার নিজস্ব নববর্ষের এই রিক্ত দশা আমরা কেউ কখনও দেখিনি, শুনিনি। কত মড়ক, কত মন্বন্তর দেখেছে বাংলা। শুনেছে ‘ফ্যান দাও’ ভিক্ষার ধ্বনি, দেখেছে অনাহারি মানুষ মরে পড়ে আছে পথে। গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে গিয়েছে কত রোগে। কিন্তু এমন আতঙ্কিত বন্দিদশা আগে দেখেনি।

Advertisement

অশান্তি ও বিভাজন— তাও সয়েছে বাংলা। ভাগ হয়ে যাওয়া পূর্ব আর পশ্চিম, যেন কারও নিজেরই দ্বিখণ্ডিত দেহ বৈরী হয়েছে পরস্পর। উচ্ছিন্ন উদ্বাস্তু শতকোটি মানুষের ভিড় আজও দুঃস্বপ্ন হয়ে ফেরে। আজও এই নিয়ে গল্প লেখা হয়, কাব্য গড়ে ওঠে। সেইসব ভয়ঙ্কর দিনে কেউ দুঃখে ছিল, কেউ সুখেও ছিল, কারও সহানুভূতি ছিল অভাজনের প্রতি, কেউ কেউ থাকতে পেরেছিল স্বার্থচিন্তায় বুঁদ। বিগত বছরেও যখন নববর্ষ এসেছে, বৈশাখের পয়লা সেই পুণ্যদ দিবস, তখনও মানুষের স্বার্থবোধ এমন আত্মকেন্দ্রিক ছিল।

এ বছর এক অনন্য সময়। এ বছর ১৪২৭ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন এক বাধ্যতামূলক সাম্যের দিন। এক অপরিচিত রোগ পৃথিবীব্যাপী নিষ্ঠুর মারণ থাবায় মানুষের অহঙ্কার ধূলিতলে মিশিয়ে ছেড়েছে। কে তুমি, কত শৌর্যবীর্য তোমার, কত সম্পদ, মান, কিছুই সে পরোয়া করেনি। যুগে যুগে কত জন এক সাম্য ও প্রেমবান পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিল। কত প্রাণ বলি গিয়েছে সেই স্বপ্নের রক্তপিপাসায়। আমাদের বাংলার ইতিহাসে কতজনের অকালমৃত্যুর ইতিকথা লেখা আছে শুধু এক সুন্দর বাসভূমি চাওয়ার অপরাধে। তাঁদের জীবিত পরিজন আজও হয়তো কেঁদে উঠছেন তাঁদের স্মরণে। সেই মূল্যে সভ্যতা এগিয়েছে কয়েক পা। কিন্তু আজ মৃত্যুভয়ে ভীত মানুষের মরণের অতি নৈকট্যে দাঁড়িয়ে যে যাপনসমতা, তা বিধ্বংসী। কেউ তা চায়নি। অথচ নতুন এসেছে দ্বারে। তাকে স্বাগত জানাতেই হবে।

Advertisement

বঙ্গে এখন এক শস্য লাভ করে অন্য শস্যবীজ বপনের কাল। এরপর বর্ষা এলে যাতে মাঠে মাঠে দুলে ওঠে ধান, যাতে লাউ-কুমড়ো-বেগুনে আকাল না আসে। এ সময় নতুন শব্দ বুঝি ঢুকে পড়ছে বাংলা অভিধানে— কোয়রান্তিন। দূরে যাও, দূরে থাকো, এমনকি নিজস্ব প্রাণের মানুষকেও ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না। হায়, এ ভাবে কি বাঁচতে পারা যায়?

হতাশ জানালা খুলে বাইরে চেয়ে দেখি, নবীন তার কাজ করে চলেছে নিরন্তর। এই যে ঋতুরূপঙ্কর মহাপ্রকৃতি, প্রতি বছর জরামুক্ত হয়ে যে ফিরে আসে নবরূপে, নবযৌবনে, সুজলা-সুফলা করে ধরিত্রীরে, তার অসীম শক্তি মানুষও তো পায়। তাই সম্বল করে তরুণ যুবকেরা বিধিনিয়ম মেনে, দুরত্বের অঙ্ক বুঝে, সাবানের উপকারিতা সম্মান করে দরিদ্রের দুয়ারে পৌঁছে দিচ্ছে চাল, ডাল, আলু। বেঁচে থাক, দিন-আনা দিন-খাওয়া মানুষেরা বেঁচে থাক। কই, সামাজিক দূরত্ব নেই তো। যারা বলছে, মানুষ আর মানুষ নেই, কয়েকটি যন্ত্র সম্বল করে নব্য প্রজন্ম এখন একক ও স্বরাট, তাঁরা কি দেখছেন এই প্রাণ হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে ত্রাণের বণ্টন? নিন্দুকে বলে, এ তো রাজনীতি, দলের ভাবমূর্তি রাখতে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে সাহায্যের হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছে। হতে পারে, নাও হতে পারে। কে জানে, করোনাভাইরাস নিয়ে যে বিশ্ব রাজনীতি সংবলিত জল্পনা, তার প্রকৃত উৎস কী। চোখ ও মন আমাদের নানা পথে টেনে নিয়ে যায়। সুপথ, বিপথ। ওই যে নওজোয়ানের দল সুখকর সেলফোনের সঙ্গ ছেড়ে, সমাজের সেবা করছে, তা, এই মুহূর্তে সমালোচনার নয়, বরং প্রশংসার। সমালোচনা রাজনীতির হোক, সরকারের খামতিটুকুর হোক, কর্মী পান তাঁর যোগ্য স্বীকৃতি।

কারও কারও আশঙ্কা, এই যে পয়লা বৈশাখে বইয়ের বিক্রি নেই, বস্ত্র বিকিকিনি বন্ধ, ছোটবড় বাণিজ্য লক্ষ্মী আর গণেশের কৃপাপ্রার্থী হয়ে বন্ধ ঘরে হা-হুতাশ করছে, তাতে বিপুল আর্থিক ক্ষতি মানুষকে বিপন্ন করে তুলবে। কিন্তু এর তো বিপরীত সম্ভাবনাও আছে। বিপুল ক্ষতি পুরতে মানুষই এগিয়ে আসবে নবতর উৎসাহে, মরণজয়ী শক্তি নিয়ে। ১৪২৭ পয়লা বৈশাখ হয়তো নীরবে তারই সূচনা করছে। করোনা আক্রমণের আগে পর্যন্ত, বর্তমান প্রজন্মের প্রতি নিন্দাবাদ ছিল জোরাল। আর ছিল চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর প্রতি অনাস্থা, অনুযোগ, চিৎকৃত অপভাষায় অসম্মান, প্রহার। ডাক্তার ও রোগী সম্পর্কটি পারস্পরিক বিশ্বাস হারিয়েছিল। একজন চিকিৎসকের অসাধুতায় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছিল হাজার মানুষের।

আজ বৈদ্যুতিন সামাজিক মাধ্যমগুলিতে ছবির পর ছবি। ক্লান্ত স্বাস্থ্যকর্মী, মৃত্যুর কাছে পরাজিত বেদনার্ত চিকিৎসক। আজ সমাজ বলছে, স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকদের ভাল রাখা দরকার। হাসপাতালের বিভাগ বন্ধ করে দিতে হচ্ছে ন্যায্য কারণেই, চিকিৎসকদের পাঠানো হচ্ছে কোয়রান্তিনে, অথচ এই বাংলায় কোনও ভাঙচুর নেই, গালাগালি নেই, দোষারোপ নেই। শাসকদলের কাজে বিরোধীরা বাধা দিতে হামলে পড়ছে না। এ এক গলাগলি চলাচলি। এক মারক জীবাণু একজনের বাঁচার সঙ্গে আরেকজনের জীবন যোগ করে দিয়েছে, একজনের মরণে হাজার মরণ।

পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিমান, সবচেয়ে শিক্ষিত, ধনবান, স্বাস্থ্যসচেতন দেশগুলিতে মৃত্যুর মিছিল। ব্যক্তি হিসেবে কবর দেবে, তেমন লোক নেই। গণকবরের মতো প্লাস্টিক মোড়া লাশ চলেছে মিলিটারি ট্রাকে। আত্মীয় নেই, পরিজন নেই, মানুষ সমস্ত সম্পদের তুচ্ছতা প্রমাণ করে মরে যাচ্ছে একা। এ দেখে মন কি একটুও পরিবর্তন হবে না? ধনীরা হয়ে উঠেছেন দানশীল, সাততারা হোটেলে জায়গা করে দেওয়া হচ্ছে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের। যে দেশ অনুদান দিতে অভ্যস্ত, সে হাত পেতে বলছে, ওষুধ পাঠাও।

ভবিষ্যৎ আমরা অনুমান করতে পারি মাত্র। কিন্তু ভবিষ্যৎ কতখানি অজ্ঞাত, মানুষ নতুন করে বুঝছে বলেই আজ নতুন বছরে কিছু আশা জাগে। বাধ্যতামূলক বিচ্ছিন্নতা থেকে হয়তো সংযোগের নতুনতর উপলব্ধি জাগবে। মানুষের জন্য মানুষ, এই বোধ ব্যাপ্ত হবে আরও। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে ফিরে এলে মানুষ বদলে যায়। যারা সন্দিহান এই বলে, পরিস্থিতি আগের মতো হলেই স্বার্থবুদ্ধি ও আত্মপরায়ণতা ফিরে আসবে পুরোপুরি, তাঁরা নিজেরাই কি জানেন, পরিস্থিতি ঠিক আগের মতোই হবে আবার? আমরা, এই বর্তমান পৃথ্বীর অধিবাসী, আমরা বিশ্বযুদ্ধ দেখিনি, প্লেগের মতো বিশ্বমারী দেখিনি। আমরা সাহিত্যে পড়েছি, ফিল্ম দেখে শিউরে উঠেছি। আমরা চেয়েছি পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধ যেন না হয়, পরমাণু বোমা যেন প্রয়োগ না করে কেউ, আর্থিক মন্দা যেন গ্রাস না করে এ জগত। শুধু শিল্পসাহিত্যের অর্জন আর আমাদের নিজস্ব মারী বা অশান্তি বা অসুখ, দারিদ্র্য, প্রতিবেশীর সঙ্গে যুদ্ধ দিয়ে আমরা বুঝতে চেয়েছি জীবনের দাম। আজ সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত যা, সেই স্পর্শ ও সঙ্গ বঞ্চিত আমরা শিয়রে মৃত্যু দেখে হয়তো জীবন ও পাশের মানুষকে আরও একটু ভালবাসতে শিখলাম।

শুনশান রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে পশুরা, পাখিরা অনেক বেশি নির্ভয় এখন, সাগরের পারে দ্রুত জন্মাচ্ছে লতাগুল্ম, যারা মানুষের পায়ের চাপে মাথা তুলতেও পারত না, কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসছে বিনা বাধায়, ছোট ছোট ইলিশেরা হয়তো পূর্ণ হয়ে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে। শহরে মানুষ বলছে, বহু দূর দিগন্তে দেখা যাচ্ছে প্রকৃতির অবস্থান, পাহাড়, জঙ্গল। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে না তেমন। রাতের আকাশে এখন কত তারা। এ সবের জন্য মানুষের ঘরবন্দি থাকার শাস্তি না পেলেও চলত, শুভবুদ্ধি থাকলে এই রোগ সন্ত্রাসের কবলে হয়তো আমরা নাও পড়তে পারতাম। এই কথাটি বলতেই এসেছে আজ পয়লা বৈশাখ ১৪২৭। আমরা হয়তো মনে রাখব এ বার, হিমবাহ গলছে, উষ্ণায়ন ও দূষণের বিষে শুধু জলতল বাড়ছে না, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে প্রবাল ও অসংখ্য প্রাণী। আমরা হয়তো শিখব, মানুষ যদি বাঁচতে চায়, তাকে অপরের জন্য বাঁচা অভ্যাস করতে হবে।

অনেকেরই হয়তো মনে পড়ছে কামুর ‘প্লেগ’ উপন্যাসটির কথা। সেই মারণ রোগ ঠিক আজকের করোনার মতোই ধন, মান, বয়স, ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে গণহত্যা করেছিল। সেই সময় পৃথিবী শিখেছিল, গোটা শহরকে কোয়রান্তিন করার দরকার হয়। মানুষ সকল তুচ্ছ করে সেবাধর্ম নিয়েছিল। জয় করেছিল সেই রোগ।

আমরাও করব জয় নিশ্চয়।

শুধু আর একটু বেশি মানুষ হব, আরও বেশি, অনেক বেশি সহানুভুতিশীল, অনেক বেশি ভালবাসতে পারা মানুষ।

আজ ১৪২৭ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখ এই হোক বঙ্গবাসীর প্রতিজ্ঞা। এই হোক জগতের পণ।

এঁকেছেন রৌদ্র মিত্র

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement