এ বছর অনলাইন প্রসাদ-মার্কা ই-সার্ভিসের কথা বড় বেশি করে মনে পড়ছে পয়লা বৈশাখের দিনে।
কয়েক বছর আগে একটা ব্যাপার বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। কম্পিউটারে অনেকেই একটা অ্যাপ ডাউনলোড করে রেখেছিলেন। সেটা দাবালে একটা দেবমূর্তি খুলে যায়, তার সামনে মাউস টিপে ধূপ জ্বালানো যায়, নারকেল ফাটানো যায়, ফুল দিয়ে অঞ্জলি দেওয়া যায়। এই ‘পূজা অ্যাপ’ মূলত ব্যবসায়ীদের জন্য নিত্যপূজার ভার্চুয়াল বন্দোবস্ত। কুলুঙ্গিতে লক্ষ্মী-গণেশ পুষে তাদের নিয়মিত ফুল-জল-নকুলদানা সাপ্লাইয়ের থেকে অনেক বেশি কনভিনিয়েন্ট এবং পরিবেশ-বান্ধব এই ভার্চুয়াল নিত্যকর্ম। জানা নেই, ইদানীং কেউ এই অ্যাপটি তাঁর কম্পিউটারে রাখেন কি না। কারণ, পুজো-টুজো এ সব এখন অনেকটাই অনলাইন। বিস্তর সাইট রয়েছে, সেখানে নগদার্থের বিনিময়ে দেশের যে কোনও মন্দিরে পুজো দেওয়া যায়, এমনকি, ক্যুরিয়ার মারফত সেই সব মন্দির থেকে প্রসাদ পর্যন্ত আনিয়ে নেওয়া যায়। ফলে নো ঝামেলা, নো ঝঞ্ঝাট। লাইন দেওয়া, ডালা হাতে ঘর্মাক্ত অবস্থায় প্রতীক্ষা, পুরোহিত বা পাণ্ডার বিত্তাপ— কোনও কিছুই সহ্য করার দরকার নেই। বাটন দাবাও আর প্যালা চড়াও। বাবা বিশ্বনাথ থেকে তিরুপতি— বেছে নিন আপনার কাকে দরকার। তেমন হলে নিত্যপূজার বন্দোবস্তও রয়েছে, কেবল খসাতে হবে কাঞ্চন। আপনার যেমন রেস্ত, তেমনই পরিষেবা পাবেন। নো কথার খেলাপ। নট কিচ্ছু।
এ বছর এই অনলাইন প্রসাদ-মার্কা ই-সার্ভিসের কথা বড় বেশি করে মনে পড়ছে পয়লা বৈশাখের দিনে। লকডাউনের বাজারে বাঙালি তার বচ্ছরকার উৎসবটাকে হারাল। তেমন আন্দাজ থাকলে পয়লা বৈশাখটাকে অনলাইনে ট্রান্সফার করা কি যেত না— এই মার্কা একটা বদ চিন্তা মস্তিষ্কে পাক খেতে আরম্ভ করল। পয়লা বৈশাখের প্রধান উপলক্ষ যদি হালখাতা হয়ে থাকে, তবে অনেক দিনই বাঙালি ব্যবসায় খেরোর খাতা থেকে সরে এসে কম্পু-নির্ভর। তবু হালখাতা করতে হয়। রিচুয়াল। তো সে ক্ষেত্রে হালখাতাকে সহজেই অনলাইন করে ফেলা যেত। কালীঘাট আর দক্ষিণেশ্বরে অনলাইন পুজো দিয়ে দোকান বা আপিসের কম্পুতে একটা সিঁদুরের ফোঁটা লাগিয়ে দিলেই তো ল্যাটা চুকে যেত। অনলাইনে পৌরোহিত্য বাঙালি তেমন ভাবে এখনও যে কেন শুরু করেনি, কে জানে! ব্যাপারটা ভেবে দেখতে পারেন প্রবাসী, থুড়ি অনাবাসীরাও। এখান থেকে মন্ত্র আউড়ে অ্যাপ মারফত দশকর্ম, ফুল-ফল ইত্যাদি ভার্চুয়াল দদাতি করে হালখাতা কেন, দুগ্গাপুজোও সামলে দেওয়া যায়। দরকার শুধু সময় আর পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে বদলে নেওয়া মনটা। সেটা সামলাতে পারলেই তো হয়ে যায়।
বাঙালি কি সময়ের সঙ্গে মনের বদলটা ঘটাতে পেরেছে? করোনা-কাতরতার যে ছবি আজও ফেসবুকে ভেসে বেড়িয়েছে, তা যথেষ্ট করুণ। বিডন স্ট্রিটের চড়কের মেলা বন্ধ, তাই নিয়ে হা পিত্যেশ। আসলে শহর কলকেতার বুকের ভিতরে যে একটা আস্ত গাঁ ডুবে রয়েছে, বাঙালি সহজে সে কথা মানতে চায় না। সেই গাঁ-টাই বেরিয়ে আসে চড়ক সংক্রান্তিতে, বিপত্তারিণী পুজোয়। এ সবকে কি অনলাইনে ট্রান্সফার করা যায়? টেকনোলজি কি পোস্ট-গ্লোবাল বাঙালিকে চক্ষু কী করে ‘চড়কগাছ’-এ ওঠাতে হয়, তা জানাতে পেরেছে? ১৯৯০-এর পরে জন্মানো বং-প্রজন্ম কি জানে কাকে বলে চড়কগাছ? কলকাতার প্রাচীন অংশে টিমটিম করে টিকে থাকা চড়ককে অনলাইনে তোলা সম্ভব নয়। ক্রিস্টোফার কডওয়েল সায়েবের লব্জ ধার করে বলা যায় সেটা একেবারেই ‘ডাইং কালচার’। ধর্ম সেখানে গৌণ, লোকাচার মুখ্য। এমন ক্ষেত্রে টেকনোলজি তাকে সাপোর্ট করবে না, এটাই স্বাভাবিক। ফলে চড়ক বাদ। ইউটিউবে গাজনের গান শুনে নিতে পারেন। তাতে দুধের স্বাদ কোকাকোলায় মিটলেও মিটতে পারে।
চিরকালের পরিচিত এই ছবি এবছর ঝাপসা।
চড়ক-গাজন অনলাইনে সম্ভব নয়, কিন্তু নববর্ষ যে সম্ভব, তা গোড়াতেই বলেছি। হালখাতা পেরিয়ে বাঙালির পয়লা বৈশাখ মানে এপার বাংলায় অন্তত বিশেষ খ্যাঁটন। সেটা অনলাইনে অর্ডার দিলেও সম্ভব। কিন্তু এ বছর সেটাও হচ্ছে না। লকডাউনে অনলাইনে ভূরিভোজন নকডাউন। কিন্তু এরই মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় কেহ বা কাহারা যেন বিবিধ রান্নাবান্নার ছবি পোস্টাচ্ছেন। জানা নেই এগুলো লকডাউনের আগে তোলা ছবি কি না। তা যদি না হয়, তা হলে ধরে নিতে হবে যে এই চরম আক্রার বাজারেও কেউ কেউ গলদা চিংড়ি, গঙ্গার ইলিশ, কচি পাঁঠা ইত্যাদি গ্রস্ত করছে। এ তো রীতিমতো ক্রাইম! এরই মধ্যে নীতিজ্ঞানসম্পন্ন নেটাগরিকরা এই সব খাদুড়ের বিরুদ্ধে খাপ পঞ্চায়েত বসিয়েছেন। কোন আক্কেলে এই দুর্দিনে এই সব খাবার-দাবারের ছবি পোস্টানো হচ্ছে, এই মর্মে জ্বলাময়ী ভাষায় বক্তব্য রাখছেন। বাঙালির এটা ভুলে যাওয়া উচিত নয়, ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের কালে যখন দলে দলে মানুষ ফুটপাতে না খেয়ে মরেছে, তখন বেশ কম দামেই সাহেব পাড়ার রেস্তরাঁয় কয়েক কোর্সের ডিনার লভ্য ছিল। সমাজতাত্ত্বিক বিনয় ঘোষ তাঁর ‘মেট্রোপলিটান মন, মধ্যবিত্ত, বিদ্রোহ’ গ্রন্থে তা প্রমাণ-সহ দেখিয়ে গিয়েছেন। এটাকে কী ভাবে নেব? সামাজিক নিষ্ঠুরতার উদাহরণ? ১৯৪৩-এর প্রেক্ষিতে যদি তা-ই ধরে নিই আর ইতিহাসবিদদের মত, সেই দুর্ভিক্ষ ছিল মানব-সৃষ্ট, এটাও মেনে নিই, তা হলে ২০২০-র এই লকডাউনকে কিছুতেই সেই ছকে দেখা যাবে না। তার পরেও কেন সোশ্যাল মিডিয়ায় পয়লা বৈশাখের খ্যাঁটন-চিত্র, এ নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে।
আরও পড়ুন: যে দিন সুস্থ আকাশের নীচে সমবেত প্রশ্বাস নিতে পারব, সে দিনই নতুন করে পয়লা ঘোষিত হবে
এ বছর পয়লা বৈশাখে বইপাড়াও বন্ধ। ফলে নেই প্রকাশকের আপিসের হালখাতাও। একটু তলিয়ে ভাবলে দেখা যায়, সেটাও তো প্রায় টিমটিম করে টিকে থাকা একটা ব্যাপার। খুব বেশি সঙ্গতিসম্পন্ন প্রকাশক ছাড়া কে-ই বা পয়লা বৈশাখের লেখক আপ্যায়ন চালু রেখেছেন? সেটাকেও অনলাইনে শিফট করা যায় সহজেই। লেখকদের রয়্যালটির টাকা অনলাইনে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ফেলে দিলেই হয়। সরবত আর মিষ্টিটা তোলা থাক নিরাপদ অবকাশের জন্য। বাকি থাকল নববর্ষের আড্ডা। সেটা ভিডিয়ো কনফারেন্সে সেরে নিলে ক্ষতি কী? আর লেখকরা কী কম আড্ডাটাই বা দিচ্ছেন? সোশ্যাল মিডিয়ায় লকডাউন তাঁদের সক্রিয়তা কয়েকশো গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। যে লেখক বছরে একটা আড়াই পাতার ছোটগল্প লিখে হাত তুলে নিতেন, তিনি তাঁর এক্সক্লুসিভিটি শিকেয় তুলে বকবকম করেই চলেছেন ফেসবুকে। মোদ্দা কথা একটাই— আর তো সহ্য হয় না! অনলাইনে আক্ষেপ-বিক্ষেপের চাষ। যে কবি বছরে তিনটে সনেট লিখে গুমসুম থাকতেন, তিনি হাজার হাজার শব্দ ব্যয় করে ‘করোনা সংহার’ মহাকাব্য লিখে সেই অনলাইনেই পোস্ট করছেন।
এ দিকে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন পেজের তরফে পয়লা বৈশাখ ফেসবুকে লাইভ আড্ডার আয়োজন। তাতে সেলেব থেকে অভাজন পর্যন্ত একপাতে। লকডাউন অন্তত এইটুকু সাম্যবাদ আনতে পেরেছে শত রঙ্গে ভঙ্গ বঙ্গদেশে। অনলাইনে কে কীসের গোলা, কে কীসের গোসাঁই! তুমিও যা, আম্মো তাই। তোমার হাতে যে ধন আছে, আমার হাতেও সেই একই টেকনোলজি। বোতাম দাবাও আর অনলাইন হো যাও। হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিয়ো কল করে তুমিও গ্যাঁজাও, আমিও গ্যাঁজাই। ফলে তলায় তলায় একটা সাম্যাবস্থা কোথাও ঘনিয়ে উঠছেই। ভার্চুয়াল পরিসরে টুনির ঘর আর রাজার ঘরের হিসাব বরাব্বর।
লকডাউনের বাজারে বাঙালি তার বচ্ছরকার উৎসবটাকে হারাল
তবে সমস্যা থেকে গেল ও পার বাংলার উদযাপনে। পহেলা বৈশাখ সেখানে প্রধান সামাজিক উৎসব। ভার্চুয়াল পরিসরে তার আন্তরিকতাকে নিয়ে আসা কি সম্ভব? বাংলাদেশের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, তাঁরাও এ বছর ঘরবন্দি উদযাপনকেই মেনে নিচ্ছেন। ভিডিয়ো কল আর কনফারেন্স আড্ডায় খুঁজে নিচ্ছেন বিকল্প। অনলাইনই রক্ষা করছে সংযোগ।
আরও পড়ুন: এ বার পয়লা বৈশাখেও ঘরবন্দি থাকতে হবে ভেবে বিষণ্ণতা আছেই
১৪২৭-এর প্রথম দিনটিতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবিধাতার কাছে আকুল প্রার্থনা— এই বিপদ কাটুক। কিন্তু সেই আকুতি কি অনলাইনে সম্ভব? কে জানে! ইন্টেলেকচুয়াল পরিসর থেকে দূরে, দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের সংসারে পয়লা বোশেখ এখন আর একটা ঘরবন্দি কর্মনাশা দিন। যিনি খাতা বেচতেন এ দিন, যিনি পুজোর ডালা বেচতেন, দোকানে গিয়ে ঘণ্টা নেড়ে আসতেন যে পুরুতমশাই, হাতিবাগান বা গড়িয়াহাটের ফুটপাতে ফতুয়া বেচেন যে ভদ্রলোক, লকডাউন তাঁকে অনলাইনে তুলে আনতে পারল না। সম্ভবও নয়। নামজাদা অনলাইন চেনগুলোই খাবি খাচ্ছে এ বছর, প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের কথা না তোলাই ভাল। প্রকৃত অথবা ভারচুয়াল— কোনও বাস্তবতাই তাঁদের কাছে সুবিধের দিশা দেখাচ্ছে না।
বাঙালির পয়লা বৈশাখে এ বছর ‘আসছে বছর আবার হবে’ ভাবটাই জোরালো। তাই যেন হয়। কাটুক এই দুর্বিষহ কাল। আর যেন কখনও মানুষকে এ দিন দেখতে না হয়। অনলাইনে, অফলাইনে সুখে থাক বাঙালি। সাদামাটা ভাত-কাপড়ের সুখ। তার বেশি আর কী-ই বা চাই!